অন্যান্যস্বাস্থ্য ও পুষ্টি

 রাতে ঘুম না আসার কারণ ও প্রতিকার

সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে রাতে বিছানায় গেলেন ঘুমাতে, কিন্তু ঘুম কিছুতেই আসছে না। এই ঘুম না আসা বা অনিদ্রা সমস্যাটি বর্তমানে খুব সাধারণ একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ দিনের শেষে যদি পর্যাপ্ত ঘুম না হয়, তাহলে শরীরের কর্মক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায়, এমনকি মনোযোগের অভাবও দেখা দিতে পারে। আজকের ব্লগে আমরা রাতে ঘুম না আসার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

পৃথিবীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষই এখন অনিদ্রা বা অ্যন্সোমনিয়া সমস্যায় ভুগছেন। বয়স্ক ব্যক্তি এবং অন্তঃসত্ত্বা নারী বা নতুন মায়েদের ক্ষেত্রে তো এই সমস্যা আছেই। এর পাশাপাশি বর্তমানে শিশু-কিশোরেরাও এই সমস্যায় ভুগছে। 

রাতে ঘুম না হওয়া বা কম হওয়া নিয়ে এ পর্যন্ত ১৫৩টি গবেষণা পর্যালোচনা করা হয়েছে। টাইমস অব ইন্ডিয়া তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে “বিশেষজ্ঞদের মতে, অনিদ্রার সমস্যা সমাধানে ভালো একটি ঘুমের জন্য আপনাকে নিয়মিত কিছু বিষয় মেনে চলার অভ্যাস করতে হবে। 

চলুন, জেনে নেই রাতে ঘুম না আসার কারণ এবং ঘুম না হলে করণীয়।  রাতে ঘুম না আসার কারণ ও প্রতিকার

ঘুম না আসার শারীরিক ও মানসিক প্রভাব

অনিদ্রা আমাদের এমন একটি সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে যে, আমরা অনেকেই মনে করি এটি অতি স্বাভাবিক ও এর কোনো খারাপ প্রভাব নেই। অধ্যাপক ওয়াকার ২০১৭ সালে তার “হোয়াই উই স্লিপ” বইয়ে লিখেছেন, ‘বিশ্বের একটা বিশাল অংশ অন্ধকারে জেগে থাকে। যে ঘুম তাদের নষ্ট হচ্ছে, সেটা যে পূরণ করা দরকার, সেটা তারা ভাবে না। তারা মনে করে, যা গেছে তা গেছে।’ 

ঘুম না আসায় নানান শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দেয়, যেমনঃ 

  • শারীরিক শক্তি ও কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়
  • মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যায়
  • মানসিক চাপ ও উদ্বেগ বৃদ্ধি পায়
  • মেজাজ খিটখিটে ও বিরক্তি প্রবণ হয়ে ওঠে
  • হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ে
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়
  • হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়
  • ওজন বৃদ্ধি ও মেটাবলিজমে সমস্যা দেখা দেয়
  • ত্বক ও চুলের সৌন্দর্য হ্রাস পায়
  • কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে

রাতে ঘুম না হলে কি কি সমস্যা হয়

রাতে ঘুম না হলে শরীরের বিভিন্ন কার্যক্ষমতা ব্যাহত হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। ঘুমের অভাব শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে, ফলে ঠান্ডা, জ্বরসহ অন্যান্য সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। একই সঙ্গে এটি হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতার উপরও প্রভাব ফেলে, যা উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের কারণ।

মানসিক স্বাস্থ্যের দিক থেকে, ঘুমের অভাব উদ্বেগ ও বিষণ্ণতার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। দীর্ঘমেয়াদে এটি মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতাকে দুর্বল করে এবং স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগের অভাব ঘটিয়ে অলসতা তৈরি করে। এছাড়াও ঘুম না হলে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় এবং ক্ষুদ্র বিষয়েও বিরক্তি দেখা দেয়।

রাতে পর্যাপ্ত ঘুম না হলে ওজন বৃদ্ধির সমস্যাও দেখা দিতে পারে। ঘুমের অভাবে শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে ক্ষুধা বাড়িয়ে দেয় এবং বেশি খাওয়ার প্রবণতা তৈরি করে। এছাড়াও, ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য বিপাকীয় সমস্যা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা তো রয়েছেই।

সামগ্রিকভাবে, রাতে ঘুম না হওয়া স্বাস্থ্যের উপর ধীরে ধীরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই, ঘুমের সমস্যা দেখা দিলে তা অবহেলা না করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

রাতের ঘুম না আসার কারণসমূহ

ঘুমের ব্যাঘাতের পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, যেমন শারীরিক সমস্যা, মানসিক চাপ, জীবনযাত্রায় অনিয়ম এবং পরিবেশগত অসুবিধা। নিচে কিছু ঘুম না আসার কারণ উল্লেখ করা হলো। 

ব্যথা বা অস্বস্তি: শরীরের ব্যথা বা শারীরিক অস্বস্তি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।

হরমোনের ভারসাম্যহীনতা: হরমোনাল সমস্যা একটি অন্যতম ঘুম কম হওয়ার কারণ। বিশেষ করে থাইরয়েডের সমস্যা বা মেনোপজের সময় হরমোন পরিবর্তন ঘুমে বাধা সৃষ্টি করে।

অতিরিক্ত ক্যাফেইন বা এলকোহল সেবন: অতিরিক্ত চা, কফি বা এলকোহল ঘুমে বাধা সৃষ্টি করে।

চাপ ও উদ্বেগ: কাজের চাপ বা ব্যক্তিগত জীবনের উদ্বেগ সহজে নিদ্রা আসতে দেয় না।

দুশ্চিন্তা ও অতিরিক্ত চিন্তা: ভবিষ্যৎ বা অতীত নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা ঘুমের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা: বিষণ্ণতা ঘুমের সমস্যা বাড়িয়ে তোলে এবং ঘুমের পরিমান হ্রাস করে।

অনিয়মিত ঘুমের রুটিন: নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে না গেলে শরীরের ঘুমের চক্রে বিঘ্ন ঘটে।

অতিরিক্ত মোবাইল বা স্ক্রিন ব্যবহার: রাতে বেশি সময় মোবাইল বা কম্পিউটার ব্যবহারের ফলে ঘুম কমে যায়।

অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস: রাতের খাবারে অতিরিক্ত মশলাযুক্ত বা ভারী খাবার ঘুমে বাধা দিতে পারে।

অস্বস্তিকর ঘুমের পরিবেশ: অতিরিক্ত শব্দ, আলো বা গরম পরিবেশে ঘুমানো কঠিন হয়।

অপর্যাপ্ত বিছানা ও বালিশের আরাম: সঠিক গদি বা বালিশ না থাকলে ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে।

বায়ুপ্রবাহের সমস্যা: সঠিক বায়ুপ্রবাহ না থাকলে ঘুমানোতে অসুবিধা হয়।

রাতের ঘুম না আসার প্রতিকার

রাতের ঘুম না আসা আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ সমস্যা সমাধানে কিছু কার্যকরী প্রতিকার গ্রহণ করা জরুরি। নিচে ১৫টি সহজ ও কার্যকরী প্রতিকার তুলে ধরা হলো:

১. নিয়মিত ঘুমের সময়সূচি মেনে চলুন

প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস গড়ে তুলুন। এটি আপনার শরীরের অভ্যন্তরীণ সময়সূচীর অভ্যাসকে  সঠিক রাখতে সাহায্য করবে।

২. আরামদায়ক ঘুমের পরিবেশ তৈরি করুন

ঘুমানোর ঘরটি নিরিবিলি, অন্ধকার এবং আরামদায়ক হওয়া উচিত। সঠিক বালিশ, গদি এবং আলো-আঁধারি পরিবেশ পর্যাপ্ত ঘুমের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

৩. রাতের খাবার হালকা রাখুন

ঘুমানোর আগে হালকা এবং সহজপাচ্য খাবার খান। মশলাদার, তেলযুক্ত বা অতিরিক্ত ভারী খাবার রাতে হজমে সমস্যা সৃষ্টি করে, যা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।

৪. মোবাইল ও স্ক্রিন টাইম কমান

রাতের বেলা মোবাইল স্ক্রীন টাইম কমিয়ে চোখ ও মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দিন। মোবাইল, টিভি বা কম্পিউটারের অতিরিক্ত ব্যবহার, আপনার ঘুমের জন্য উপযোগী মেলাটোনিন হরমোন উৎপাদনকে বাধাগ্রস্ত করে।

৫. নিয়মিত শরীরচর্চা করুন

প্রতিদিন নিয়মিত শরীরচর্চা মানসিক চাপ কমায় ও ঘুমের পরিমান বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তবে ঘুমানোর আগে ব্যায়াম এড়িয়ে চলুন, কারণ এটি শরীরকে দুর্বল করতে পারে।

৬. ক্যাফেইন ও এলকোহল পরিহার করুন

রাতে চা, কফি এবং সর্বদা এলকোহল সেবন থেকে বিরত থাকুন। এগুলো স্নায়ুতন্ত্রকে উত্তেজিত করে এবং ঘুমের ভাব কাটিয়ে দেয়। 

৭. মেডিটেশন ও রিলাক্সেশন অনুশীলন করুন

ঘুমানোর আগে ধ্যান বা শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের অনুশীলন মানসিক শান্তি আনে এবং ঘুমের জন্য মনকে প্রস্তুত করে।

৮. দিনের বেলায় ঘুমানোর সময় নিয়ন্ত্রণ করুন

দুপুরের ঘুমকে ২০-৩০ মিনিটের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখুন। দীর্ঘ সময় ঘুমালে রাতে ঘুমের চক্র নষ্ট হতে পারে।

৯. সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখুন

ঘুমানোর ঘরের তাপমাত্রা আরামদায়ক রাখা জরুরি। অতিরিক্ত গরম বা ঠাণ্ডা পরিবেশে ঘুমানো কঠিন হয়ে পড়ে।

১০. ঘুমের ওষুধ সেবন

ডাক্তারের পরামর্শে নির্ধারিত ঘুমের ওষুধ সেবন করুন। এক্ষেত্রে rivotril 0.5 mg এর মতো অতি অল্প ডোজের ওষুধগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে।  এগুলো অস্থায়ীভাবে ঘুমের সমস্যা সমাধানে সাহায্য করবে।

১১. মানসিক চাপ কমানোর কৌশল অনুসরণ করুন

দিনের মানসিক চাপকে রাতে ঘুমের সময় নিয়ে আসবেন না। পজিটিভ চিন্তা ও স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট চাপ কমাতে সাহায্য করে।

১২. বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন

ঘুমানোর আগে বই পড়ার অভ্যাস মনকে শান্ত রাখে। তবে ই-বুক বা মোবাইলে পড়ার চেয়ে প্রিন্ট বই পড়া ভালো।

১৩. শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ থেরাপি

ঘুমানোর সময় শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ বা ডিপ ব্রিদিং থেরাপি অনুসরন করুন। এটি মস্তিষ্ককে শান্ত করে এবং ঘুমের জন্য মনকে প্রস্তুত করবে।

১৪. গরম পানির শাওয়ার নিন

ঘুমানোর আগে গরম পানির শাওয়ার নিলে শরীর রিল্যাক্স হয়। এটি শরীরকে প্রশান্তির ঘুমের জন্য প্রস্তুত করতে সহায়ক।

১৫. বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিন

মানসিক সমস্যার পাশাপাশি, ঘুম না হওয়ার ক্ষেত্রে শারীরিক সমস্যাও দ্বায়ী হতে পারে। যদি ঘুমের সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত। 

কোন ভিটামিনের অভাবে শরীর দুর্বল হয়

কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত?

রাতে ঘুম না আসা একটি সাধারণ সমস্যা হলেও এটি যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। ঘুমের সমস্যার সঙ্গে মাথাব্যথা, অবসাদ, মানসিক চাপ বা উদ্বেগের মতো উপসর্গ যুক্ত হলে এটি গভীরতর কোনো স্বাস্থ্য সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। এ ধরনের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।

এছাড়াও, শারীরিক সমস্যার কারণে যদি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, যেমন শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, থাইরয়েড সমস্যা বা রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম, তবে দ্রুত চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা প্রয়োজন। এগুলোর যথাযথ চিকিৎসা না করলে সমস্যা আরও জটিল হতে পারে।

যদি ওষুধ, ক্যাফেইন বা অন্যান্য উপাদান ঘুমের সমস্যা সৃষ্টি করে এবং নিজ থেকে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব না হয়, তবে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে এই বিষয়ে পরামর্শ নেওয়া দরকার। চিকিৎসক প্রয়োজনীয় থেরাপি বা ওষুধ নির্ধারণ করে সঠিক সমাধান দিতে পারেন।

সবশেষে মূল কথা, ঘুমের সমস্যা যদি আপনার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলতে শুরু করে এবং এর ফলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, তবে এটি অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

উপসংহার 

রাতে ঘুম না আসা একটি সাধারণ কিন্তু গুরুতর সমস্যা, যা আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। রাতে ঘুম না আসার কারণ ও প্রতিকার জানার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান সম্ভব। তবে, ঘুমের সমস্যা মাত্রাত্নক হলে, অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। মনে রাখবেন, সুস্বাস্থ্য এবং কর্মক্ষম জীবনের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম অপরিহার্য। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *