এমপি আফজাল হোসেনের পরিবারতন্ত্রের জাল
এমপি আফজাল হোসেনের পরিবারতন্ত্রের জাল
অনেক এমপির বিরুদ্ধেই স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ, তবে কিশোরগঞ্জ-৫ (বাজিতপুর-নিকলী) আসনের সরকারদলীয় এমপি আফজাল হোসেন এ ক্ষেত্রে এক ধাপ এগিয়ে। এমপি আফজাল হোসেন নিজ এলাকায় যেভাবে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা অনেকের চিন্তারও বাইরে। এমপি আফজাল হোসেন এক ভাইকে বানিয়েছেন পৌরসভার মেয়র, আরেক ভাইকে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। এছাড়াও শ্যালক, ভাগনেসহ আরও অনেক আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠজনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেছেন এবং দলেও গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছেন তাদের।
এভাবে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে দুই উপজেলায় দখলবাজি আর দুর্নীতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েছেন তিনবারের এমপি আফজাল হোসেন সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এমপি আফজাল হোসেন ও ঘনিষ্ঠজনের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের শিকার এলাকার মানুষ। এখন তাদের হাত থেকে পরিত্রাণ চান স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারাও। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও চেয়েছেন, সরেজমিন অনুসন্ধানে মিলেছে এসব তথ্য।
সরকারদলীয় এমপি আফজাল হোসেনের ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন আশরাফ বাজিতপুর পৌরসভার মেয়র। এলাকার মানুষ বলছেন, এই দুই ভাই বাজিতপুর-নিকলী এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। ২০০৮ সাল থেকে আফজাল হোসেন আওয়ামী লীগের এমপি। এরই মধ্যে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন দীর্ঘদিন ধরে লাগামহীন দুর্নীতি ও প্রভাব খাটিয়ে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে ও তাদের নানা অপকর্মের কথা এখন এলাকার মানুষের মুখে মুখে।
কাঁচা দুধ খাওয়া কি আদৌ উপকারী
বাজিতপুর-নিকলীর রাজনৈতিক নেতারাও বলেন, আফজাল ও আশরাফের দাপটে স্থানীয় রাজনীতিতে কেউ দাঁড়াতে পারছেন না। বাজিতপুর-নিকলীর এলাকার রাজনীতির সব ক্ষেত্রে আত্মীয়করণ করা হয়েছে। এমপি আফজাল হোসেন নিজেই প্রভাব খাটিয়ে বাজিতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ ধরে রেখেছেন আবার ছোট ভাই আশরাফকে করেছেন বাজিতপুর পৌরসভার মেয়র। মেয়র আশরাফ বাজিতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। উপজেলা কমিটির সহসভাপতি এবং বন ও পরিবেশ সম্পাদক করা হয়েছে আরও দুই ভাইকে।
একইভাবে বাজিতপুরের হেলালপুর ইউনিয়নে ভাই গোলাম কিবরিয়া নবেল ও বলিয়াদী ইউনিয়নে ভাগনে আবুল কাশেমকে (কালা কাশেম) বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। এমপি আফজাল হোসেনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় আবদুল হক জুয়েল গাজীরচর ইউনিয়ন ও শ্যালক ওমর ফারুক রাসেল আলীমপুর ইউনিয়নে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। এমপি তাঁর বেয়াইয়ের ছেলে জাফর ইকবালকে পিরীজপুর ইউনিয়ন, ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হাবিব মিঞাকে কৈলাগ ইউনিয়ন ও তাঁর ঘনিষ্ঠ একজনকে হুমাইপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বানিয়েছেন।
একইভাবে নিকলী উপজেলায় রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে কারার পরিবারকে। কারার সাইফুল ইসলামকে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং উপজেলা চেয়ারম্যান করা হয়েছে। কারার শাহরিয়ার তলিবকে বানানো হয়েছে নিকলী উপজেলা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। কারার পরিবারের সদস্যদের উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ বহু পদ দেওয়া হয়েছে।
সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া বাজিতপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের জমি আত্মসাৎ করেছেন এমপি আফজাল হোসেন ছোট ভাই মেয়র আনোয়ার হোসেন আশরাফ। ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ঐ জমি নিজেদের দখলে নিয়ে দুই ভাই সেখানে মার্কেট নির্মাণ করছেন। বাজিতপুর, সরারচর, দিলালপুর, পিরীজপুরসহ অনেক বাজারে নামকাওয়াস্তে ইজারা নির্ধারণ করে নিজেরাই দখলে রেখেছেন।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, যে বাজারের ইজারার ডাক হওয়ার কথা ৬০ লাখ টাকা, সেখানে ইজারা দেন বিশ লাখ টাকা। বেঙ্গলাও নদী এমপি ও তাঁর ঘনিষ্ঠরা ভাগাভাগি করে খাচ্ছেন। বিল-হাওর নিজেদের ইচ্ছামতো ব্যবহার করছেন তারা। দুই ভাই প্রভাব খাটিয়ে এলাকার বিভিন্ন জলমহাল থেকে অর্থ লুটে নিচ্ছেন। যার মধ্যে রয়েছে, বেঙ্গলা চরবাদা, কইয়া খায়রা, মাইজচর, বাহেরবালী, হুমাইপুর, ঘোড়াউত্রা নদী জলমহাল।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, এলাকার রাস্তাগুলোর নির্মাণকাজের ঠিকাদারি কাজ পান এমপির আত্মীয়স্বজনরাই। ফলে কাজ মানসম্মত হয় না। যে রাস্তা পাঁচ বছর টেকার কথা, তা ছয় মাসেই নষ্ট হয়ে যায়। আফজাল এমপি হওয়ার পর প্রতিবেশীদের সরিয়ে দিয়ে প্রায় ৭০ শতাংশ জমিতে তিনতলা পাকা বাড়ি করেন। এমপির বাজিতপুরের নোয়াপাড়া গ্রামে নিজের বাড়িটি নির্মাণ করেছেন দখল করা জমিতে। অভিযোগ রয়েছে, এমপি আফজালের নামে-বেনামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ফ্ল্যাট, শেয়ার, একাধিক গাড়ি রয়েছে। একাধিক ব্যাংকে মেয়াদি আমানত রয়েছে।
বিয়ের দাবিতে পুলিশ সদস্যের বাড়িতে ছাত্রীর অনশন
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা আফজাল ও আশরাফের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছেন। বাজিতপুর উপজেলা আওয়ামীলীগ নেতা ফারুক আহাম্মদ বলেন, এমপি আফজাল হোসেন ও তাঁর ভাই মেয়র আনোয়ার হোসেন আশরাফ প্রভাব খাটিয়ে বাজিতপুর-নিকলী আসনটিকে পরিবারতন্ত্রে রূপ দিয়েছেন। লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করতে দুই ভাই মিলে এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন।
তাদের দুর্নীতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। তাদের লুটপাটের কথা বলে শেষ করা যাবে না। নিজের পরিবারের সদস্য, স্থানীয় বিএনপি ও তাঁর অনুগত কিছু হাইব্রিড লোকজনকে ধরে এনে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। দলের ত্যাগী নেতাকর্মী কাউকেই দলীয় কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত রাখেননি।
পিরীজপুরের আওয়ামী লীগ নেতা ও ব্যবসায়ী হারুনুর রশীদ সুমন বলেন, এলাকার আওয়ামী লীগকে ভেঙে ব্যক্তিগত লীগ বানিয়েছেন এলাকার আওয়ামী লীগকে ভেঙে ব্যক্তিগত লীগ বানিয়েছেন। আমরা পরিবর্তনের জন্য বাজিতপুর-নিকলীতে সভা-সমাবেশ করছি। এমপি, তাঁর ভাই, ভাগনে, শ্যালকদের টেনে এনে গুরুত্বপূর্ণ পদপদবিতে বসিয়ে বাজিতপুর-নিকলীর রাজনীতি ধ্বংস করে দিয়েছেন। আফজাল ও আশরাফের বাজিতপুর-নিকলীর মানুষ পরিবর্তনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এমপি আফজাল হোসেনকে ঠেকাতে এবার এলাকার চার নেতা মাঠে নেমেছেন। এ আসনে আগামী নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হতে আগ্রহী কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষকলীগের সাবেক সহসভাপতি ফারুক আহাম্মদ, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অজয় কর খোকন, স্বেচ্ছাসেবকলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য রফিকুন্নবী সাথী ও যুবলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক সুব্রত পাল।