বিধ্বস্ত জনপদ সেন্ট মার্টিন
বিধ্বস্ত জনপদ সেন্ট মার্টিন
ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতের পরদিন গিয়ে আমরা দেখলাম এক অচেনা সেন্ট মার্টিনকে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে ঝুপড়িঘরগুলো, আধা পাকা ঘর ভেঙে পড়েছে, কোনো কোনো ভবনের টিনের ছাউনি উড়ে গেছে, নারকেল গাছগুলোর মাথা ভাঙা।
বাংলাদেশে মোখার আঘাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনপদ সেন্ট মার্টিন। ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্র বাংলাদেশে শুধু সেন্ট মার্টিনের ওপর দিয়েই গেছে, বাতাসের গতিবেগ সর্বোচ্চ ছিল ঘণ্টায় ১৪৭ কিলোমিটার। মিয়ানমারের ওপর দিয়ে গেছে বাকিটা।
দ্বীপের বাসিন্দার বলেন, সেন্ট মার্টিনে এমন ঝড় কখনো দেখেননি তিনি। জলোচ্ছ্বাস না হওয়ায় মানুষ বেঁচে গেছে। কিন্তু দরিদ্র মানুষের ঘরবাড়ি টিকে নেই। বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দ্বীপ সেন্ট মার্টিন। সেন্ট মার্টিন দ্বীপটিতে ১১ হাজারের মতো মানুষের বাস। গত রোববার দুপুর ১২টার দিকে ঘূর্ণিঝড় মূল আঘাত হানার সময় দ্বীপের বেশির ভাগ মানুষ হোটেল-রিসোর্টে আশ্রয় নিয়েছিল। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে বাতাসের গতি কমে। মানুষজন গিয়ে দেখে, লন্ডভন্ড হয়ে গেছে তাদের ঘরবাড়ি। এটি বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন।
বহুমাত্রিক সংকট এখন সেন্ট মার্টিনের। সুপেয় পানির সংকটও দেখা দিয়েছে। গত এক মাস ধরে দ্বীপের বিভিন্ন জায়গায় খাওয়ার পানির সংকট চলছিল। সৌরবিদ্যুতের আলো পাওয়া যাচ্ছে না। টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনের পথে স্বাভাবিক নৌ চলাচল গতকাল পর্যন্ত শুরু হয়নি। জেনারেটর চালানোর মতো জ্বালানি তেল নেই। অবশ্য মোবাইল নেটওয়ার্ক ফিরেছে।
মোখার বিদায়ের ২৩ ঘণ্টা পর যখন সেন্ট মার্টিনের নৌযান ভেড়ানোর ঘাটের কাছাকাছি, তখন নারকেলগাছের ভাঙা মাথা দেখে দূর থেকেই বোঝা গেল মোখার ধ্বংসচিহ্ন। নারিকেল জিনজিরা নামে খ্যাত দ্বীপটির নারকেল গাছগুলো মোখার আঘাতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দক্ষিণ পাড়া, কোনাপাড়া, উত্তর পাড়া, পূর্ব পাড়া সব জায়গায় চিত্রটি একই। বিধ্বস্ত বসতবাড়ির মধ্যে কেউ কেউ অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন, কেউ কেউ রাতে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করতে ঘর কোনোরকমে মেরামতের সেই চেষ্টা করছিলেন, কেউ কেউ ঘরেরন্নার উপকরণ কিছু টিকে আছে কি না, খুঁজে দেখছিলেন।
সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমানের বলেন আমরা ক্ষয়ক্ষতির ধারণা আগেই পেয়েছিলাম। তিনি জানান, দ্বীপে এক হাজার ৯০০টির মতো ঘরবাড়ি আছে। ৭০০টির মতো ঘরবাড়ি প্রায় পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। এসকল কাঁচা অথবা ঝুপড়ি টিন, ত্রিপল অথবা চাটাই দিয়ে তৈরি। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও ৩০০টির মতো ঘর। হোটেল, রিসোর্ট, ও দোকানপাট ক্ষতির মুখে পড়েছে। অনেক গাছপালা ভেঙেছে। কয়েকটি রেস্তোরাঁ ও রিসোর্টে গিয়ে দেখা যায়, পাকা দেয়াল টিকে আছে। তবে টিনের ছাউনি উড়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিদ্যালয়, মসজিদ ও মাদ্রাসা। যেমন ক্রিড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২ টি আধা পাকা ভবনের একটির টিনের চালা পুরোপুরি দুমড়েমুচড়ে গেছে। কবে নাগাদ শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে, তা নিশ্চিত নন এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
মাছ ধরে জীবন চলে সেন্ট মার্টিনের বেশির ভাগ মানুষের। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বেশ কিছুদিন ধরে মাছ ধরা বন্ধ। আবার প্রজনন মৌসুমের কারণে ২০ মে থেকে সাগরে ৬৫ দিনের জন্য মাছ ধরা নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। কেউ কেউ শীত মৌসুমে পর্যটন ঘিরে কাজ করেন, ক্ষুদ্র ব্যবসা করেন। এখন পর্যটন মৌসুমও নয়। এমন সময়ে বেশির ভাগ মানুষের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে ঘূর্ণিঝড় মোখা।
ঘূর্ণিঝড়: সংকেতে কী বোঝায়
ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পরদিন গতকাল সেন্ট মার্টিন পরিদর্শনে যান কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান, কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম ও টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান, বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের জোনাল কমান্ডার (পূর্ব জোন) ক্যাপ্টেন সোহেল আজম। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক বলেন, যেসব বাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে, সেগুলোর তালিকা করা হচ্ছে। মঙ্গলবার (আজ) থেকে পুনর্বাসনের কাজ শুরু হবে। যাঁদের ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাঁদের নগদ অর্থসহায়তা দেওয়া হবে। জেলা প্রশাসন ও কোস্টগার্ডের পক্ষ থেকে কিছু ত্রাণসামগ্রীও বিতরণ করা হয়েছে।
বেলা তিনটার দিকে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে রওনা দেয় কোস্টগার্ডের একটি উচ্চগতির নৌযানে (হাইস্পিড বোট-এইএসবি-১০)। এই নৌযান সাধারণত ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টার মধ্যে টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনে পৌঁছায়। তবে সাগর উত্তাল থাকায় আমাদের লাগল প্রায় দুই ঘণ্টা।
Pingback: বিদ্যানন্দের কিশোর কুমারকে আইনি নোটিশ - Amader Khabar