মানব জীবাশ্মের সন্ধান, বদলে দিচ্ছে বিবর্তনের ধারণা
কিসের টানে আমাদের পূর্বপুরুষেরা বার বার ফিরে এসেছিল ডেনিসোভা গুহায়? সাইবেরিয়ার আল্টাই পর্বতের মাঝে সারা বছর স্যাঁতসেঁতে গুহা ডেনিসোভা। এখানে নিয়ান্ডারথাল, আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষ ও ডেনিসোভানরা বিভিন্ন সময়ে আশ্রয় নিয়েছিল। মানুষের বিবর্তন সরলরৈখিক নয়, বরং জালের মতো। বিবর্তনে অন্তত ১৫টি প্রজাতির আদিম মানুষের আগমন হয়েছিল, যারা বিভিন্ন সময়ে আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষের সঙ্গে সহাবস্থান করেছিল। আধুনিক মানুষের সঠিক পূর্বপুরুষের পরিচয় আজও ধূসর। মানব বিবর্তনের রাস্তা একটা চমকপ্রদ অধ্যায়, এখনও যার জট ছাড়ানো চলছে। সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকার গুহায় পাওয়া মানব জীবাশ্মের বয়স ৩৪ লাখ বছর থেকে ৩৬ লাখ বছর বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এর ফলে এতোদিন মানব বিবর্তন নিয়ে বিজ্ঞানীদের যে ধারণা ছিল তা পুরোপুরি বদলে যাচ্ছে।
আগেও ১৯৭৯ সালে ইথিওপিয়াতে প্রথম লুসি নামের যে জীবাশ্ম পাওয়া গিয়েছিল তার বয়স ছিল ৩২ লাখ বছর। লুসি ছিল অস্ট্রালোপিথেকাস প্রজাতির। নতুন আবিষ্কার করা জীবাশ্মও এই প্রজাতির।
সিএনএন জানিয়েছে, আগে ধারণা করা হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার স্টারকফন্টেইন গুহার ওই জীবাশ্মের বয়স ২০ লাখ থেকে ২৬ লাখ বছর হতে পারে। তবে এবার বিজ্ঞানীরা নতুন একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে সেই জীবাশ্মের বয়স বের করেছেন। তাতে জানা গেছে সেগুলো আরও অন্তত ১০ লাখ বছর পূর্বের।
এটি জোহানেসবার্গ থেকে থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই গুহাটি ইউনেস্কোর ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় রয়েছে।
এখানে ৩৬ লাখ বছর আগে পৃথিবীতে বসবাসকারী বিখ্যাত লিটল ফুটসহ শত শত অস্ট্রালোপিথেকাস জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। লাখ লাখ বছর আগের এই অস্ট্রালোপিথেকাস কঙ্কাল বর্তমান বিজ্ঞানীদের শিম্পাঞ্জির মতো পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে আরও জানতে সাহায্য করে চলেছে। এর আগে ১৯৭৯ সালে ইথিওপিয়াতে প্রথম লুসি নামের যে জীবাশ্ম পাওয়া গিয়েছিল তার বয়স ছিল ৩২ লাখ বছর। লুসি ছিল অস্ট্রালোপিথেকাস প্রজাতির। নতুন আবিষ্কার করা জীবাশ্মও এই প্রজাতির। হোমো সাপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষ একেবারেই আলাদা, অনন্য- এমনটা ভেবে নেওয়া খুবই সহজ। এমন একটা সময় ছিল, যখন পৃথিবীর বুকে হোমো সাপিয়েন্স ছাড়াও মানুষের অন্যান্য প্রজাতির বাস ছিল। প্রায় ৩ লাখ বছর আগে পৃথিবীতে আফ্রিকার বুকে হোমো সাপিয়েন্সের উদ্ভবের সময় থেকেই নিয়ান্ডারথালস, হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস, ডেনিসোভানস, হোমো লুজোনেনসিস ও হোমো নালেদিসহ মানুষের অনেক প্রজাতির বাস ছিল পৃথিবীতে। এসব প্রজাতির অনেকের সঙ্গে স্যাপিয়েন্সরা বংশবৃদ্ধিও করেছে। এদের অনেকেরই ফসিল রেকর্ড সংরক্ষিত আছে, তবে আমাদের ডিএনও থেকেই ডেনিসোভানদের সম্পর্কে বেশিরভাগ তথ্য জানা গেছে। প্রতিনিয়তই মানব বিবর্তনের ব্যাপারে আমরা যা জানি তাতে পরিবর্তন আসছে। এটি প্যালেওঅ্যানথ্রপলজির অন্যতম চমকপ্রদ বিষয়।
এখন পৃথিবীতে জীবিত প্রাণীদের মধ্যে প্রাচীন হোমো স্যাপিয়েন্সদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ স্বজন হচ্ছে শিম্পাঞ্জি ও বোনোবো। নৃতত্ত্ববিদদের মতে, ৬০ লাখ বছরের বেশি সময় আগে আধুনিক মানুষ ও এদের এক অভিন্ন পূর্বপুরুষ ছিল। ওই অভিন্ন পূর্বপুরুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষেরা বিভিন্ন প্রজাতিতে বিকশিত হন। তাদের বলা হতো হোমিনিন। লাখ লাখ বছর ধরে হোমিনিনরা অনেকটাই বানরের মতো থেকে যায়। তারা ছিল খাটো, মস্তিষ্কের আকারও ছিল ছোট এবং সাধারণ পাথরের অস্ত্র-সরঞ্জামই কেবল তৈরি করতে পারত তারা।
আফ্রিকায় মানুষের হোমোগণের শুরুটা পঁচিশ লক্ষ বছর আগে, অস্ট্রালোপিথেকাস নামক দ্বিপদী থেকে। প্রায় কুড়ি লক্ষ বছর আগে প্রথমবার এক দল পূর্ব আফ্রিকা থেকে বাকি পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া শুরু করেছিল। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বিপদসঙ্কুল অচেনা অরণ্যে লড়াইয়েই জন্ম নিয়েছিল আরও নতুন প্রজাতি। ইউরোপে নিয়ান্ডারথাল, পূর্ব এশিয়াতে হোমো ইরেক্টাস, জাভা দ্বীপপুঞ্জে হোমো সোলোয়নসিস (সোলো মানব), ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোর দ্বীপপুঞ্জে ফ্লোরেসিয়েনসিস (হবিট)। হঠাৎ করে সমুদ্রস্তর বেড়ে যাওয়াতে প্রত্যন্ত দ্বীপে আটকে পড়ে হবিট জনগোষ্ঠী। মনে করা হয় পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে এদের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়েছিল। উচ্চতা ছিল মেরেকেটে এক মিটার। এরা পাথরের সামগ্রী তৈরিতে সক্ষম ছিল।
আট লক্ষ বছর আগে মানব ইতিহাসে হঠাৎ আগুন আবিষ্কার। আগুনের ব্যবহার খাদ্য পরিপাক পদ্ধতিকে আমূল বদলে আমাদের পূর্বপুরুষকে বেশ খানিকটা এগিয়ে দিয়েছিল। বিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে বিজ্ঞানীরা আজও সর্বসম্মত নন।
মানব বিবর্তনের গোড়া থেকে এমনই বহু অজানা চরিত্রের আগমন ঘটেছে, যারা বদলে যাওয়া প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে ইতিহাসের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে। আধুনিক মানুষ বিবর্তনের পথে এমন বহু আত্মীয়দের হারিয়েছে, যাদের পরিচয় অনেকাংশে অজানা হলেও গুরুত্ব অপরিসীম।
বিবর্তনের কোন পরিকল্পনায় টিকে গিয়েছে মানুষের আধুনিক প্রজাতি? জার্মানির এক গুহাতে আবিষ্কার হয়েছিল ৩২ হাজার বছরের পুরনো প্রথম মানব শিল্প, ভাস্কর্য ‘লায়নম্যান’— মানুষের দেহ ও সিংহের মুখ। অর্থাৎ, তখনই মানুষ কল্পনা করতে শিখেছিল। মানুষের গল্প বলার শুরুটা সেই থেকেই। কল্পনাশক্তিই তো টিকিয়ে রাখে আধুনিক মানুষকে