নাটোরের কাঁসাশিল্প বিলুপ্তির পথে
নাটোরের কাঁসাশিল্প বিলুপ্তির পথে
আধুনিকতার প্রসারে কাঁসাশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে একসময় কাঁসার তৈরি তৈজস সামগ্রীর ব্যবহার ছিল সর্বত্র। মানুষের ঘরে দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রী থেকে শুরু করে মসজিদ, মন্দিরে ব্যবহার হতো কাঁসাসামগ্রী। উত্তরাঞ্চলের নাটোরও এর ব্যতিক্রম নয়। সবচেয়ে বেশি কাঁসার পণ্য নাটোরের লালপুর ও সিংড়া উপজেলায় তৈরি হতো। লালপুর উপজেলার লালপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে ছিল ওই কাঁসাসামগ্রী তৈরির কারিগরদের বসবাস।
স্থানীয়রা জানান, একসময় বিভিন্ন রকমের ব্যবহারিক তৈজস তৈরির সময় কাঁসার ঢকঢক, ঝনঝন শব্দে ও ক্রেতাদের আনাগোনায় মুখর থাকতো কাঁসাপল্লি।
জানা যায়, সিন্ধু সভ্যতা হলো তাম্র প্রস্তর যুগের একটি সভ্যতা। মানুষ প্রথম ধাতু হিসেবে তামা ব্যবহার শেখে নব্য প্রস্তর যুগে। এরপর ব্রোঞ্জ ধাতুর ব্যবহার শুরু হয় ঐ সময় মানুষ তামা ও ব্রোঞ্জ দুটো ধাতুই ব্যবহার করতো বলে একে তাম্র প্রস্তর যুগ বলে। ভারতীয় উপমহাদেশে পাল শাসনামলে তামা-কাঁসার ব্যবহার হয়েছে। এছাড়াও পাল যুগের প্রাপ্ত অসংখ্য তাম্রলিপিতে বিধৃত ‘প্রশস্তি’ অংশে সংস্কৃত ভাষাচর্চা ও শৈল্পিক মানসম্পন্ন কাব্য রচনার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। এই ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায় সেন বংশের রাজত্বকালেও। সেনরাই ছিল হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রবর্তক। ধাতু দিয়ে তখন তির-ধনুক, বন্দুক, ঢাল, তলোয়ার, কামান পর্যন্ত তৈরি করা হতো। তখন ধীরে ধীরে কাঁসা দিয়ে বিভিন্ন দৈনন্দিন নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র তৈরি করা শুরু হয় এবং কাঁসাশিল্প ক্রমে বিস্তার লাভ করে।
বাংলাদেশের একাধিক জনপদে কাঁসারিদের বসবাস ও কাঁসাসামগী তৈরির কথা জানা যায়। বিশেষ করে নদীমাতৃক গ্রামগুলোতে বাণিজ্যতরি যেতো স্বাচ্ছন্দ্যে। বণিকের হাঁকডাক, মজুরের ছোটাছুটি, শানবাঁধানো আসনে মালিক-কারিগরের উপবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হতো পৈতৃক ওই পেশা রক্ষার শুভযাত্রা। ঘরে ঘরে সাজানো থাকতো ঝকঝকে কাঁসার সামগ্রী। কাঁসাপণ্য ব্যবহারের অনেক উপকারিতা ছিল কেননা, এতে দাগ ধরে না বলে ছিল মানুষের প্রিয়। কঠিন ধাতু বলে বংশানুক্রমে টিকে থাকতো গৃহকোণে, দেবালয়ে। মরিচা ধরে না। অম্ল বস্তুতে বিক্রিয়াও ঘটে না।
মুসলিমদের ওজুখানায় শোভা পেতো কাঁসার বদনা। হুঁকা খাওয়া কিংবা সামাজিক ডেকচি থেকে শুরু করে ঢাকের খোলও তৈরি হতো কাঁসা দিয়ে। সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে দেওয়া হতো কাঁসার বাসনপত্র। গ্রামের বধূর কাঁকে (কোমর) শোভা পেতো কাঁসার কলসি। শুধু তা-ই নয়, মন্দির, রথ ও রাসযাত্রায় শত শত ঘণ্টা; ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের প্রদীপ, দেবদেবী মূর্তিশোভিত দীপদানসহ গৃহস্থের ঘরে ব্যবহার হতো বড় বড় থালা, পূজা ও ভোজনের পাত্র। সারা দেশের মতো নাটোরও এর ব্যতিক্রম ছিল না। এসব এখন সোনালি অতীত।
নবাবী আমলে কাঁসার বণিক ও শ্রমিকরা ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে থেকে নাটোরের লালপুর, কলমসহ নবাবগঞ্জ এলাকায় শিল্প স্থাপন করেন। ১৪ জন মহাজনের মাধ্যমে ৪ শতাধিক শ্রমিক প্রতিদিন প্রায় ৫০০ কেজি কাঁসাসামগ্রী উৎপাদন করতেন। কিন্তু এখন এই কাঁসাপল্লিতে ৩ জন মহাজনের মাধ্যমে তিনটি কারখানায় ১৫ জন শ্রমিক প্রতিদিন প্রায় ৪০ কেজির মতো সামগ্রী তৈরি করছেন। তখন প্রায় ৫০টি কারখানায় টেডি প্লেট, বর প্লেট, ফুলদানি, পাতিল, বগি থালা, বিভিন্ন ডিজাইনের গ্লাস, গলাচিপাকলস, রেকাব, পানদানি, চুনদানি, ডাবর (বুল), জগ, বাটি, পিকদানি, চামচ, ডেকচি, হাতল, ঘণ্টা ইত্যাদি তৈরি করতেন তারা।
মাধুরী বিয়ে অন্তঃসত্ত্বা না হওয়ার শর্তে স্বাক্ষর
কাঁসা শিল্পের কারিগর নজরুল ইসলাম বলেন, মানুষ আগের মতো এখন আর কাঁসার তৈরি জিনিস কিনতে চায় না, অর্ডারও কম। এ অবস্থায় অনেকেই পেশা বদল করেছেন। তারা মাত্র কয়েকজন বাপ-দাদার পেশা ধরে রেখেছেন। নাটোর শহরের কাঁসার দোকানি গণেশ জানান, মানুষ আগের মতো এসব আর কিনতে চায় না। কাঁসার ছোট ১ বাসন নিতে হলে তার দাম এখন প্রায় ৫০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা। এ কারণে কম দামে প্লাস্টিক, মেলামাইন, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি সামগ্রী কেনে।
লালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বলেন, লালপুরে ঐতিহ্য বহন করে আসছে কাঁসাশিল্প। এই শিল্প দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে দিতে আমি নিজেই কাসাঁর তৈরির জিনিস অনেককে উপহার দিয়ে থাকি। কিন্তু বর্তমান আধুনিকতার ছোঁয়ায় কাঁসার তৈরির জিনিসের চাহিদা কমে যাওয়ায় শিল্পটি প্রায় বিলুপ্তির পথে। আমরা কাঁসাশিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য উপজেলা প্রশাসনসহ উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।