স্বাস্থ্য ও পুষ্টি

তরুণের দেহেও বাসা বাঁধছে ডায়াবেটিস

সাধারণত অন্য রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে রক্ত পরীক্ষায় ধরা পড়ে ডায়াবেটিস। তরুণ বা যুবকরা যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, সেটি লক্ষণে বোঝা যায় না প্রায় ক্ষেত্রেই। চিকিৎসকরা বলছেন, শুয়ে বসে থাকা, ফাস্ট ফুডে আসক্তি, খেলাধুলা না করাসহ নানা কারণে শিশু, কিশোর ও তরুণদের মধ্যেও ডায়াবেটিসের প্রকোপ বাড়ছে। আধুনিক জীবনের নানা সুযোগ সুবিধা কায়িক পরিশ্রম কমিয়ে জীবনকে সহজসাধ্য করলেও তা তৈরি করছে নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি।

ডায়াবেটিস থাকলে অন্য রোগ সারতেও দেরি হয়, যে কারণে রোগটি শনাক্ত করা জরুরি। ডায়াবেটিস নিজেও যেমন শারীরিক নানা জটিলতার কারণ, সেই সঙ্গে এটির কারণে অন্য রোগও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। তাই রোগটি নিয়ে সচেতনতার তাগিদ দিয়ে বিশ্বজুড়েই একটি দিবস পালন করা হয়। ডায়াবেটিস শিক্ষা ভবিষ্যতের সুরক্ষা প্রতিপাদ্য নিয়ে নানা আয়োজন রাখা হয়েছে বাংলাদেশেও। তারা বলছেন, যুবক বয়সে এখন অনেক রোগী পাওয়া যাচ্ছে, যা আগে সেভাবে দেখা যায়নি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে সচেতনতার তাগিদ দিচ্ছেন।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডায়াবেটিস, থাইরয়েড ও হরমোন বিশেষজ্ঞ ইন্দ্রজিৎ প্ৰসাদ বলছেন, তারা যত রোগী যাচ্ছেন তাদের মধ্যে ১২ শতাংশের বেশি যুবক এবং তা বাড়ছে। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এর কারণ যুবকরা এখন খেলাধুলা বা কায়িক শ্রম কম করে, তারা ফাস্টফুডে আসক্ত, সেই সঙ্গে মোবাইল, ইন্টারনেটে সময় কাটাচ্ছে বেশি। এখন তরুণ ও যুবক বয়সে অনেক রোগী পাচ্ছি আমরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমেরিটাস অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহও তিনিও জানান, তরুণরা খেলাধুলা, শারীরিক পরিশ্রম করেন না, অলস জীবন যাপন, খাওয়া দাওয়াতে অনিয়ম, টেনশন এগুলোর জন্যই রোগটি হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, তরুণ বা যুবকরা যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, সেটি লক্ষণে বোঝা যায় না প্রায় ক্ষেত্রেই। সাধারণত অন্য রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে রক্ত পরীক্ষায় ধরা পড়ে সেটি।

একজন তরুণ কী লক্ষণে বুঝবেন তিনি আক্রান্ত:-দেশবরেণ্য অধ্যাপক আবদুল্লাহ বলেন, ‘লক্ষণ বলতে তেমন কিছু নাই। অনেক সময় কিছুই বোঝা যায় না। এমনও হয় খুব খায় কিন্তু ওজন কমে যাচ্ছে ও শুকিয়ে যাচ্ছে, অনেক সময় অনেক পিপাসা লাগে, ক্লান্তি অনুভব হচ্ছে।

ঝুঁকিতে ও শিশুরা:- রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে সাড়ে ছয় বছর বয়সী একটি শিশুকে শারীরিক দুর্বলতা ও ঠান্ডার সমস্যা নিয়ে ভর্তির পর পরীক্ষায় প্রকাশ পেল সেও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। চিকিৎসকরা ধারণা করছেন, এটা জন্ম থেকেই হয়েছে। আমরা মনে করি, ডায়াবেটিস বয়ষ্কদের হয়। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। ডায়াবেটিসের কয়েকটা ধরন আছে। এটি নবজাতক শিশু থেকে শুরু করে বয়ষ্ক সবার হতে পারে। নবজাতকের যে ডায়াবেটিস হয়, তাকে বলা হয় নিউন্যাটাল ডায়াবেটিস। এটি সাধারণত জন্মের পর থেকে ছয় মাসের মধ্যে হয়ে থাকে বলছেন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ইন্দ্রজিৎ প্ৰসাদ । শিশুদের মধ্যে ৫ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি। এর বাইরেও বিশেষ ধরনের ডায়াবেটিস রয়েছে যেটা গর্ভাবস্থায় হয়। এটি সাধারণত প্রেগন্যান্সির ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহে হয়। অনেক ক্ষেত্রে এটি চলে যায় আবার কখনও কখনও তা সন্তান প্রসবের পর থেকেও যায়।

বোঝা যাবে সন্তান এই রোগে আক্রান্ত কি না:- অধ্যাপক ইন্দ্রজিৎ বললেন, ওজন কমে যাওয়া, দৃষ্টিশক্তিতে সমস্যা, অতিরিক্ত দুর্বলতা, মাথাব্যথা, খেলাধুলায় আগ্রহ থাকে না, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যওয়া ইত্যাদি লক্ষ্মণ দেখা দেয় তারে মধ্যে। শিশুদের ক্ষেত্রে আগে নির্ণয় করতে হবে কোন টাইপ ডায়াবেটিস। টাইপ ওয়ান হলেও ইনসুলিন। যদি টাইপ-টু হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে হাঁটাহাঁটি বা খেলাধুলা করতে হবে। শিশুরা এই রোগে আক্রান্ত হয় কেন এই প্রশ্নে তিনি বললেন, তাদের ক্ষেত্রে ছয় মাসের পর টাইপ ওয়ানে আক্রান্ত হওয়ার কারণ অগ্ন্যাশয়ের বিটাসেল [যেখান থেকে ইনসুলিন তৈরি হয়] ধ্বংস হওয়া। এটা অটো ইমিউনিটির কারণে হয়। তাই সন্তানকে প্রথম দুই বছর শিশুকে অবশ্যই মায়ের বুকের দুধ দিতে হবে।

ডায়াবেটিসের কারণ কী?
মা বা বাবার যে কোনো একজনের ডায়াবেটিস থাকলে সন্তানের ঝুঁকি থাকে ১০ শতাংশ। চিকিৎসকদের মত প্রধানত বংশগত কারণে রোগটি হয়ে থাকে। আর দুজনেরই থাকলে ঝুঁকি থাকে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ। আবরা অতিরিক্ত মোটা হয়ে গেলে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। যারা স্লিম তাদের তুলনায় মোটা মানুষদের ঝুঁকি দশ গুণ বেশি। স্ট্রেস বা মানসিক চাপও রোগটির একটি বড় কারণ। অতিরিক্ত মানসিক চাপে স্ট্রেস হরমোন তৈরি হয়। এই হরমোনগুলো বেশি তৈরি হলেও তা ডায়াবেটিসের কারণ হতে পারে। অধ্যাপক ইন্দ্রজিৎ বলেন, অনেকেই অতিরিক্ত রাত জাগেন এবং সঠিক নিয়মে ঘুমান না। এতে তার ডায়াবেটিস হতে পারে।

সুগার ফল হতে পারে বিপজ্জনক:- ৪২ কোটি ২০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী। এদের বেশিরভাগই নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে বাস করে এবং প্রতি বছর ২ লাখ ৮৪ হাজার ৪৯ জনের মৃত্যু হয় সরাসরি ডায়াবেটিসের জন্য। ধারণা করা হয়, অন্তত ১২ শতাংশ বাংলাদেশে মানুষ রোগটিতে আক্রান্ত। চলতি বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করা একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের ১ কোটি ৩১ লাখ মানুষের ডায়াবেটিস আছে।
ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইন্দ্রজিৎ বলেন, ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের অন্য রোগীদের তুলনায় দুই থেকে চার গুণ বেশি আশঙ্কা থাকে হার্ট অ্যাটাকের। হাইপোগ্লাইসেমিয়াতেও মানুষ মারা যায়। এটি সাধারণভাবে সুগার ফল বলে পরিচিত। কেউ যদি ডায়াবেটিসের ওষুধ বা ইনসুলিন বেশি পরিমাণে গ্রহণ করেন অথবা সঠিক পরিমাণে খাবার না খান বা একেবারেই বাদ দেন, তাহলে তার সুগার ফল হতে পারে। প্রতিরোধের উপায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, দিনে ছয় বেলা অল্প করে বার বার খেতে হবে। সঠিক নিয়মে হাঁটাহাঁটি করতে হবে। ওষুধ এবং ইনসুলিনের মাত্রা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক নিয়মে এডজাস্ট করতে হবে।

প্রতিরোধে উপায়:- ১. প্রতিদিন অন্তত ২০ মিনিট হাঁটতে হবে, ২. ২৪ ঘণ্টায় ছয় ঘণ্টা ঘুমাতে হবে,৩. সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। চিকিৎসকদের মত হলো, ৮৫ শতাংশ ডায়াবেটিস প্রতিরোধযোগ্য। বংশে রোগটির প্রকোপ থাকলেও কিছু নিয়মেনে এটি প্রতিরোধ করতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *