জাতীয়

রেলে উন্নয়নে মোটা-তাজা হচ্ছে  কালো বিড়াল

রীতিমতো উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে রেল। বাংলাদেশ রেলওয়ের উন্নয়নের জন্য প্রকল্পের যেন শেষ নেই। শুধু চলমান ৩৯টি প্রকল্পেই বরাদ্দের পরিমাণ পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা। বলা যায় রীতিমতো উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে রেল।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দায়িত্বশীলদের অনেকেই ছুটছেন কালোটাকার পেছনে। যে কারণে রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ, স্টেশন সংস্কার ও টিকিট কালোবাজারি ঠেকাতে নজর নেই তাদের। রেলের শত অনিয়ম-দুর্নীতির কাছে সাধারণ যাত্রীরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। এ যেন অসহায় আত্মসমর্পণ। অভিযোগ রয়েছে-জড়িতদের চিহ্নিত করাসহ তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কখনও নেওয়া হয় না। নেই কোনো জবাবদিহিতা। এসব কারণে

অনিয়ম, দুর্নীতি ও নিম্নমানের যাত্রীসেবার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, সেবা-নিরাপত্তায় নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হচ্ছে। দুর্নীতিতে জড়িতদের চিহ্নিত করে নেওয়া হচ্ছে কঠোর ব্যবস্থা। কয়েকজনের চাকরি গেছে। এখনো অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা ঘুরছেন দুদকের বারান্দায়।

তবে রেলের আধুনিকায়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। বর্তমান সরকার রেলের উন্নয়নে অনেক নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব প্রকল্প শেষ হলে রেলে আমূল পরিবর্তন সাধিত হবে। টিকিট কালোবাজারি বন্ধে ইতোমধ্যে শতভাগ টিকিট অনলাইনে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে ১৪২টি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। তবে যাত্রীর তুলনায় এখনো ট্রেনের সংখ্যা অনেক কম। ফলে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় যাত্রী সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রেলে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অনেক ক্ষেত্রেই প্রমাণিত। ফলে যাত্রীসেবা প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পের কটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা অনুযায়ী হচ্ছে? রেললাইন স্থাপনে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় কত? এগুলো উন্নত রাষ্ট্রের চেয়েও অনেক বেশি দেখানো হচ্ছে। তাই প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ঠিকাদার পর্যন্ত সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। তাদের সম্পদের পরিমাণ এবং উৎসও খোঁজা উচিত।

দেশের প্রধানতম স্টেশন ঢাকার কমলাপুরে ঢুকলেই সারা দেশের রেল সেবার পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায়। এখানে স্টেশন চত্বর ঢাকা পড়েছে ময়লা-আবর্জনায়। প্ল্যাটফরমের নিচে রেললাইনজুড়ে মলমূত্র ও নোংরা পানিতে সারাক্ষণ ঠাসা থাকে। ওদিকে প্ল্যাটফরমে সারাক্ষণ লেগে থাকে ছিন্নমূল মানুষের জটলা। নেশাগ্রস্তদের উৎপাতে নিরাপত্তাহীন পরিবেশ। মুহূর্তে টানা পার্টি ও ছিনতাইয়ের কবলে পড়ার আশঙ্কা থাকে। স্টেশনে সুপেয় পানির যেমন তীব্র সংকট রয়েছে, তেমনি গণশৌচাগার নিয়ে দুর্ভোগের যেন শেষ নেই। কারণ ৭টি প্ল্যাটফরমের কোথাও নেই শৌচাগার। স্টেশন মাস্টারের কক্ষ লাগোয়া ছোট্ট টয়লেটে একজন ঢুকলে লম্বা লাইন পড়ে যায়। কিছুটা দূরে আরেকটি পাবলিক টয়লেট থাকলেও তা এসি টিকিটের যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত দেশে রেল স্টেশনের সংখ্যা ৪৪৮টি। তবে প্রধান স্টেশনের অবস্থা এমন হলে বাকিগুলোর অবস্থা কি তা সহজেই অনুমেয়।

নামেই স্টেশন: প্রায় সাড়ে চারশ স্টেশনের মধ্যে মাত্র ৭টিতে প্ল্যাটফরমজুড়ে ট্রেন দাঁড়াতে পারে। বাকিগুলোয় ট্রেনের ৪ ভাগের ৩ ভাগই প্ল্যাটফরমের বাহিরে থাকে। প্ল্যাটফরমের বাহিরে নামা যাত্রীদের অনেক সময় ঝোপ-জঙ্গলেও নামতে হয়। ফলে রোদ-বৃষ্টি এবং রাতে অন্ধকারে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

মাদক সেবনের উপকরণ কিংবা মলমূত্রে ভরা থাকে টয়লেট। এছাড়া তেল চিটচিটে অপরিচ্ছন্ন সিটে বসে যাত্রীদের যাতায়াত করতে হয়। মন না চাইলেও অনেক যাত্রী বাধ্য হয়ে এ ধরনের নোংরা সিটে বসেন। কখন ট্রেন আসবে? এটি আরও একটি বড় সমস্যা। এ বিষয়ে ঘোষণার ব্যবস্থা নেই খোদ কমলাপুর স্টেশনে। ছাড়ার ঘোষণা থাকলেও কখন এসে পৌঁছবে তা বলা হয় না।অনেক সময় একেবারে শেষ মুহূর্তে ঘোষণা দেওয়া হয়। এরফলে যাত্রী হুড়োহুড়িতে পড়ে অনেকে আহত হন। এ সময় নারী, শিশু ও বয়োবৃদ্ধদের নিয়ে ট্রেনে ওঠা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।

বিষধর সাপেরও ভয় থাকে। আবার ৯০ শতাংশ স্টেশন প্ল্যাটফরম থেকে ট্রেনের উচ্চতা বেশি। উচ্চতা বেশি হওয়ায় ট্রেনে উঠতে গিয়ে হরহামেশা দুর্ঘটনার কবলে পড়েন যাত্রীরা। অথচ এমন বাস্তব সমস্যা মাথায় নিয়ে ট্রেনের প্ল্যাটফরম করা হয়নি। গত এক যুগে কমলাপুর স্টেশন চার দফায় সংস্কার করা হয়। কিন্তু এখনো সেখানে সব প্ল্যাটফরম ট্রেনের পাদানির সমউচ্চতায় করা হয়নি। ৫৩টি স্টেশনের প্ল্যাটফরম ট্রেনের উচ্চতায় করার জন্য কাজ চলছে, যা শুরুতেই করা উচিত ছিল।

১০৪টি আন্তঃনগর ট্রেনে পস মেশিন (পয়েন্ট অব সেলস) অপর্যাপ্ত। ফলে বিনা টিকিটে ভ্রমণ রোধে টিকিট যার ভ্রমণ তার এই নীতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। বেশ কয়েকটি আন্তঃনগর বেশিরভাগ ট্রেনে টিকিট পরীক্ষার জনবল (টিটিই) নেই। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা যাত্রী পরিষেবার মানোন্নয়ন করা নিয়ে অনেক কথা বলে থাকেন। কিন্তু মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি ভিন্ন। কারণ রেল সেবার গোড়ায় গলদ রয়েছে। সেবা ব্যবস্থা যাদের দেখভাল করার কথা তাদের কোনো ধরনের জবাবদিহিতা নেই। রেল কর্মচারীদের অনেকে ব্যক্তিস্বার্থে সব সময় ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এতে করে তাদের কাজও করা লাগে না, আবার ক্ষমতার ছড়ি ঘুরিয়ে উলটো খবরদারি করা যায়। এছাড়া নানা রকম স্বার্থ হাসিলের সুযোগ তো আছেই। ফলে চাকরি ফেলে তারা সারা বছর সরকারি দলের সভা-সমাবেশ নিয়ে বেশি সময় ব্যয় করেন।

টিকিট বাণিজ্য: পরিসংখ্যান বলছে, যাত্রীবাহী ট্রেনের মোট আসনের বিপরীতে গড়ে ৭৭ শতাংশ টিকিট বিক্রি হচ্ছে। অবিক্রীত ২৩ শতাংশ সিটেও বিনা টিকিটে বসে গন্তব্যে যাচ্ছেন। ৫ কিংবা ১০ দিন আগে দূরপাল্লার ট্রেনের টিকিট দেওয়া শুরু হলে আধা ঘণ্টার মধ্যেই তা শেষ হয়ে যায়। জানা যায়, একটি চক্র সারা বছর সিস্টেম করে কালোবাজারে টিকিট বিক্রি কিংবা টিকিটবিহিন যাত্রী নিয়ে নিজেরা পকেট ভারী করেন। ৭০-৭৫ শতাংশ টিকিট বিক্রি হওয়ার পর তারা বাকি সিট সিস্টেম করে ব্লক দেন। এরপর ট্রেন ছাড়ার সময় চক্রটি টিটিইদের ফোনে বলে দেন-কোন কোচে কোন কোন সিরিয়াল থেকে কতটি সিট খালি রয়েছে। তখন জরিমানা আদায়সহ প্রায় দ্বিগুণ দামে এসব সিট বিক্রি করা হয়। যার অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হয় না।

এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব বলেন, আমাদের সমিতি থেকে ২০১৬ সালে একটি জরিপ করেছিলাম জরিপে উঠে আসে ৮৭ শতাংশ ট্রেনযাত্রী রেলের সেবা ও নিরাপত্তায় সন্তুষ্ট নন। ৭২ শতাংশ যাত্রী টিকিট কাটতে দুর্ভোগ ও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।

পাশের দেশ ভারতে রেল কিন্তু বেশ লাভজনক গণপরিবহণ। কিন্তু আমাদের দেশে লাগাতার লোকসান। এর প্রকৃত কারণ যতদিন উদ্ঘাটন না করা যাবে এবং এজন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে যতদিন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হবে না-ততদিন আমাদের রেলের এসব সমস্যার সমাধান হবে না।

বর্তমান ট্রেনের গতি গড়ে ঘণ্টায় ৬৩ কিলোমিটারের নিচে। অথচ বিপুল অঙ্কের টাকা ব্যয় করে ১২০-১৪০ কিলোমিটার গতিবেগের ট্রেন ইঞ্জিন ও কোচ কেনা হয়েছে। যার সুফল জনসাধারণ পাচ্ছেন না। ২২-২৩ অর্থবছরে বরাদ্দ ১৮ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। এত বিনিয়োগেও ট্রেনের গতি বাড়ে না। শর্ষের মধ্যে ভূত. হাতেগোনা কয়েকটি ট্রেনে মাঝে মধ্যে দেখা যায় টিস্যু রোল, বদনা, সাবান, চাদর এমনকি বালিশ পর্যন্ত চুরি হয়ে যাচ্ছে। যথাযথ মনিটরিং থাকলে ট্রেনের মধ্যে এভাবে চুরি হওয়ার কথা নয়। আসলে এ রকম ঘটনা দু-একটি ঘটলেও বাস্তবে চোরের ওপর দায় চাপিয়ে এসব লুটপাট করছেন ট্রেনের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সংশ্লিষ্ট কয়েকজন সৎ কর্মকর্তা বলেন, খাতা-কলমে কেনাকাটা ও সরবরাহ দেখিয়ে রেলের প্রশাসন বিভাগ এবং টিটিইরা এগুলো টাকার অঙ্কে নিজেরা ভাগাভাগি করেন। শর্ষের মধ্যে ভূত থাকায় এসব বড় চোরদের ধরার কোনো উপায় নেই।

ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলনে ঝড় তুলেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মহিউদ্দিন আহমেদ রনি। তিনি একাই আন্দোলন চালিয়ে গেলেও পরে সব পেশার মানুষ তার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। একপর্যায়ে রেল কর্তৃপক্ষ তার দাবিগুলো মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেয়। এ প্রসঙ্গে মহিউদ্দিন আহমেদ রনি বলেন, যাত্রীসেবা-নিরাপত্তায় বড়ই বেখেয়ালি রেল। সবার দৃষ্টি শুধু প্রকল্পের দিকে। কারণ প্রকল্পের মধু আহরণে তারা তৎপর।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *