ভ্রমণ

ভ্রমণ গল্প মিতালী

ভ্রমণ গল্প মিতালী
ভৈরব টু সিলেট
মোঃ মফিজুল ইসলাম (মাহফুজ)

ঢাকা থেকে ভৈরব হয়ে সিলেটগামী বাস গুলোর মধ্যে মিতালী পরিবহনটি অধিক পরিচিত একটি বাহন।
সেই ছোটবেলা থেকেই এই বাসগুলোকে দেখে আসছি। বিশেষ করে জুম্মা পড়তে ফেরিঘাট মসজিদে যাওয়ার সময় কৌতুহল বসত ফেরির জন্য অপেক্ষমান গাড়ি গুলোর দিকে চোখ বুলাতাম। অপেক্ষমান বাসগুলোর মধ্যে মিতালী পরিবহনের সংখ্যাই থাকতো বেশি।
সেই থেকেই মিতালীর প্রতি একটা আকর্ষণ কাজ করতো। বি-বাড়িয়া সরকারি কলেজে পড়াশোনাকালীন সময়ে মাঝে মধ্যে মিতালী পরিবহন দিয়ে বিশ্বরোড পর্যন্ত যেতাম, কিন্তু এটির মাধ্যমে কখনো সিলেটের দিকে যাওয়া হয়নি।
ইদানিং ছোট ভাইয়ের পোস্টিং সিলেট হওয়ায় মাঝে মধ্যেই সিলেটে যাওয়া হয়।
সিদ্ধান্ত নিলাম এইবার বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত চাপা ইচ্ছেটা পূরণ করবো।
তাই একদিন হাতে যতেষ্ট সময় নিয়ে এবং সর্বনিম্ন ভাড়া দিয়ে সিলেট যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে চলে এলাম ভৈরব ব্রিজের টোল প্লাজায়।
বাসের অপেক্ষায় দাড়ানো…. ১০ মিনিটের মধ্যেই মিতালী এসে হাজির…বাসের হেল্পার কিছুটা দূর থেকেই দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এই সিলেট.. সিলেট.. সিলেট… সুনামগঞ্জ বাইপাস.. সিলেট.. বলে চিৎকার করতে করতে আমাদের সামনে এসে জিজ্ঞেস করলেন সিলেট যাবেন? প্রতিউত্তর পাওয়ার আগেই হেলপার মহোদয় তার দুই হাত ও মুখের কারুকার্যের মাধ্যমে আমাদেরকে গাড়িতে উঠতে তাড়া দিতে লাগলেন এবং আমার পাশে দাড়ানো মহিলাদের ব্যাগধরে টানাটানি শুরু করতেই তাদের মধ্যে হালকা বাকবিতন্ডা হয়েগেলো। আসলে আমি ছাড়া এখানে সিলেটে যাওয়ার আর কোনো যাত্রী ছিলোনা। এদিকে টোল দেওয়ার লাইনে বাসটির সিরিয়ালও কাছাকাছি এসে পড়েছে তাই হেলপার মহোদয়ও একটু তাড়াহুড়ো করতে যেয়ে মহিলাদের হাতে সমান্য নাজেহাল হয়েছিলেন।

যাই হোক আমি সিলেট যাবো জানাতেই সে বলল তারাতাড়ি ওঠেন..ভাই তাড়াতাড়ি ওঠেন। আমি ভাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সে বলল… আপনের কাছ থাইক্কাকি বেশি নিমু মিয়া? ওঠেন। আবারও ভাড়া কতো জিজ্ঞেস করলাম উত্তরে সে ৩০০ টাকার কথা বললো
আমি ডানহাতের তর্জনি উঁচিয়ে দেখালাম (এক আঙুল ১০০টাকা) – এমনিই সে রাগান্বিত স্বরে বললো ১০০ টাকা টাকাদিয়া সিলেট যাইবা? গাড়িদিয়া না গিয়া বিমান দিয়া যাও! আমি কিছু বললামনা। টোল প্রদান শেষে গাড়িটি ধীরগতিতে সামনের দিকে এগোতেই হেলপার আমাকে ২০০ টাকায় যাবো কিনা জিজ্ঞেস করলো আমি মাথা নাড়িয়ে না করলাম তারপর বললো ১৫০ যাইবেন? পরোক্ষণেই ১২০ বলে বাসটি চলেগেলো।

পরবর্তী বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
এরমধ্যে সিলেটগামী এক ভদ্রলোক আমার পাশে এসে দাড়িয়েছেন।
যাইহোক ১৫ মিনিটের মধ্যেই আরেকটি মিতালী এসে হাজির হেলপার সাহেব যথারীতি হাক-ডাক করতে করতে আমাদের কাছে আসলেন। ভাড়া চাইলো ২০০ করে। আমরা ১০০ বলতেই একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো
দাদাভাই ১২০ টাকা কইরা দিয়াদিয়েন আর কোন কথা বইলেন না উইঠাযান।
উঠে দেখি বাস ফুল হাউস যাকে বলে কানায় কানায় পরিপূর্ণ কোনো রকমে এক পায়ে দাড়িয়ে রয়েছি। এদিকে গাড়ি ছাড়তেই কন্ট্রাকটার সাহেব বললেন, ভাই আপনেরা দুইজন পিছনের দিকে যানতো… সামনের সবাই আশুগঞ্জ নামবো। এই ভিরে কিভাবে যাবো বলতেই উনি সাথে করে আমারদের পিছনের দিকে নিয়ে যেতে লাগলেন, এই ৮/১০ হাত যায়গা পার হতে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়েছে, সেই সাথে পায়ে পারা দেওয়ার কারণে কয়েক জনের কটুকথাও শুনতে হয়েছে। পিছনের দিকে এসে দেখি আমার ইন করা সার্টটি অর্ধেক খুলেগিয়েছে, সাথের ভদ্রলোকটিও যেন কুঁচকে গিয়েছেন তার অবস্থা নাজুক। এরই মধ্যে কেও একজন স্যার বলে সালাম দিলো, তাকিয়ে দেখি আমাদের কলেজ ড্রেসপরা একছাত্রী। তার সাথে কুশল বিনিময় করলাম, ছাত্রীটি হোস্টেল থেকে বাড়ি যাচ্ছে। বিশ্ব রোড নামবে। এরইমধ্যে গাড়ি আশুগঞ্জে থামলো এখানে বেশকিছু যাত্রী নেমে গেলেও পরোক্ষণেই তা ফিলাপ হয়ে আবারও কাণায় কানায় পরিপূর্ণ।
তবে মিতালী পরিবহনটি আশুগঞ্জ থেকে একটানেই সরাইল বিশ্বরোড পর্যন্ত চলে আসলো।
এখানে থামতেই কেরামতির মতো সকল যাত্রী নেমে পরলো, বলতে গেলে বাস এক প্রকার খালি। আমরা কেবল ৬/৭ জন বসা।
এই সুযোগে আমি একদম সামনের দিকে ডানপাশের সিট দখল করে বসলাম, উদ্দেশ্য সবকিছু ভালো করে উপভোগ কারা।
বিশ্বরোডের মোড়ে এই গাড়িগুলোর ১০/১৫ মিনিট সিরিয়ালে দাঁড়ি থাকতে হয়। এই সুযোগে গাড়ির হেলপার, ড্রাইভার ও কন্ট্রাকট্টর সকলেই যাত্রীর জন্য হাক- ডাক শুরু করে দিয়েছেন। যাত্রীদের বিভিন্ন মটিবেশন সহ ব্যাগ টানাটানিও চলছে।
যাই হোক এরইমধ্যে একদল ইস্কনের লোক কন্টাকটারের সাথে বেশ কিছুক্ষণ বার্গেডিং করে জনপ্রতি ১২০ টাকা করে শায়েস্তাগঞ্জ যাবার জন্য বাসে উঠলো। শায়েস্তাগঞ্জ সিলেট পৌছানোর আরো অনেক আগের একটি বাসস্টপিজ। আমার তখন মনে হলো ভাড়ার দিকথেকে আমরা অনেক জিতে গিয়েছি। আসলে দূর পাল্লার এই লোকাল ধরনের গাড়িগুলো এমনই, বার্গেডিং করে যাত্রীরা উঠতে গিয়ে অনেকে জিতে যায় আবার অনেক যাত্রীর নিকট হতে ফাস্টক্লাস গাড়ির মতো ভাড়া নিয়ে যায়।
যাইহোক বাসের মধ্যে পুরনো একটি হিন্দি অডিও গান চলছে (পিয়ার কিয়াতো ওয়াদা নিবানা) ভালোই লাগছিলো কিছুটা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম কিন্তু ড্রাইভার সাহেব এসে গাড়ি স্টার্ট দিতেই ঐতিহাসিক গানটি বন্ধ হয়ে গেলো।
প্রত্যাশিত যাত্রী না পেলেও এখানকার নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় গাড়িটি অস্তে আস্তে সিলেটের পথে চলতে লাগলো………
কিছুক্ষণের মধ্যেই মোগল শাসনামলের স্মৃতি বিজড়িত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা হাতিরপুল এবং তিতাস নদী পার হয়ে মাধবপুর বাসস্ট্যান্ডে এসে গাড়িটি থামল…….. এখানে যাত্রীর চেয়ে হকারের সংখ্যা বেশি অর্থাৎ এখান থেকে দুই জন যাত্রী গাড়িতে উঠলেও হকার উঠেছে অন্তত আধা ডজন।

যাই হোক গাড়ি এগিয়ে চলছে আপন গতিতে। রাস্তার দুই পাশের অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে অনেকটা সময় পার হলো। এদিকে বেলা ডুবে অন্ধকার হয়ে এসেছে। আমার চোখে ঘুম ঘুম ভাব চোখ দুটি বন্ধ করে একটু ঝিমুচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ চলার পর ভৈরব থেকে ওঠা আমার সহযাত্রীর ধাক্কায় ঝিমুনি কাটলো।
তিনি জানালেন বাসওয়ালা “আমাদের বিক্রি করেদিয়েছে” তাই নামতে হবে।
বাস ওয়ালাদের যাত্রী বিক্রির সাথে আমি পূর্ব পরিচিত, তবে এতো দূরপাল্লার মিতালী বাস তাদের যাত্রায় রণভঙ্গ দিবে এটা আইডিয়া করতে পারিনি। শায়েস্তাগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে অবস্থানরত গাড়িটিতে তখন আমরা কেবল ৬ জন যাত্রী। কন্ট্রাকটর সাহেব আমাদের নিয়ে কুমিল্লা ট্রান্সপোর্টের সিলেট গামী একটি বাসে উঠিয়ে দিলেন।
সেই সাথে মিতালী দিয়ে সিলেট পর্যন্ত যাওয়ার আশা ভঙ্গ হলো।

ভ্রমনের সাল -২০২১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *