প্রবাসী

ইতালির বৈধতার দীর্ঘসূত্রতায়, বাংলাদেশিরা…

রোমের উপকণ্ঠে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকার অভিবাসীরা জানিয়েছেন তাদের দুর্দশার কথা। ইতালির রোমে অবস্থানরত অনিয়মিত বাংলাদেশি ও আশ্রয়প্রার্থীরা চাকরি, বাসস্থান ও বৈধতাসহ নানা ভোগান্তিতে রয়েছেন। ২০১৯ সালের অনিয়মিত অভিবাসীদের নিয়মিত করার সবশেষ ঘোষণা দেয় ইতালি। এই নিয়মিতকরণের আওতায় বৈধতা পেতেও ছিল নানা শর্ত। ন্যূনতম দুই বছর ধরে ইতালিতে থাকা এবং একটি বৈধ কাজে যুক্ত থাকার শর্তেই নিয়মিত হওয়ার সুযোগ পায় অভিবাসীরা।

ইতালির সর্ববৃহৎ অভিবাসন সংস্থা আরচির মতে, ২০১৯ সালের নিয়মিতকরণের আওতায় প্রায় ৩ লাখ অভিবাসী বৈধতা পেতে আবেদন করেছিল। দুঃখজনক হলেও সত্যি এই আবেদনকারীদের প্রায় অর্ধেক এখনও তাদের বৈধতার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন। অভিবাসন সংস্থা বাওবাব এক্সপেরিয়েন্সের স্বেচ্ছাসেবক আলিচি বাজিগলনি বলেন, ২০১৯ সালের প্রক্রিয়াটি একটি ভুয়া ও লোক দেখানো বৈধতা ছিল। এটির আওতায় আবেদন করা বহু অভিবাসী কয়েক বছরের ধরে এখনও কোনো প্রকার সিদ্ধান্ত ছাড়াই দিন পান করছে।

পেশায় মহামারি বিশেষজ্ঞ এই অভিবাসী কর্মী আরও বলেন, প্রকৃতপক্ষে ইতালির পাবলিক সার্ভিসের বিপুল সংখ্যক আবেদন যাচাই বাছাইয়ের সক্ষমতা নেই। ইমিগ্রেশন দপ্তর ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনে লোকবল ঘাটতি। এক্ষেত্রে আমি মনে করি বর্তমান কট্টর ডান সরকারের পাশাপাশি আগের মধ্য-বামপন্থি সরকারেরও সদিচ্ছার অভাব ছিল।
রোমে একটি ফুড ডেলিভারি কোম্পানিতে খাবার বিতরণের কাজ করেন বাংলাদেশি অভিবাসী মোহাম্মদ আবদুর রব। চল্লিশোর্ধ এই অভিবাসী বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স হয়ে ২০১৭ সালে ইতালিতে আসেন। পাঁচ বছর ধরে ইতালিতে বসবাসের পরও এখনও অনিয়মিত অভিবাসী হিসেবে রোমে আছেন তিনি। রোমের একটি ব্যস্ত এলাকায় অনলাইনে অর্ডারের অপেক্ষায় ছিলেন রবসহ আরও কয়েকজন বাংলাদেশি অভিবাসী। এ সময় মোহাম্মদ আবদুর রব জানান, আমি প্রথমে সিলেট থেকে যুক্তরাজ্যে এসেছিলাম। লন্ডনে বেশ কিছুদিন থেকে পরে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানেও এক বছর থেকে বৈধতা না পেয়ে এক ব্যক্তির পরামর্শে ইতালি আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তিনি আরও বলেন, ফ্রান্স থেকে আমি ওই ব্যক্তির কথায় ২০১৭ সালে ইতালিতে চলে আসি। কিন্তু তিনি ছিলেন মূলত একজন দালাল। এই চক্রটি আমাকে ইতালিতে দ্রুত বৈধতার প্রস্তাব দিয়ে নানা উপায়ে আমার কাছ থেকে প্রায় দশ লাখ টাকাও হাতিয়ে নেয়। আসলে তারা আমাকে যেসব পন্থা দেখিয়েছিল সবগুলো বেআইনি ও অবৈধ। যেটি পরে আমি ইতালিতে এসে বুঝতে পারি। তারা আমাকে তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে বৈধতা পাইয়ে দেওয়ার কথা জানালেও সেটি আসলে আর বাস্তবায়ন হয়নি। পরে আমি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আমার প্রবাস জীবন চালিয়ে যাই। ২০১৯ সালে ঘোষিত বৈধতা প্রক্রিয়ার আওতায় হাজারো অভিবাসীদের মতো আবেদন করেছিলেন। বৈধতা পেতে একজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে একটি কাজের চুক্তিও কিনতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। তাকে প্রতি মাসে ৩০০ ইউরো বা ত্রিশ হাজার টাকারও বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে আমাকে।

আবদুর রব বলেন, আমি একজন অনিয়মিত অভিবাসী হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে একটি বৈধ চুক্তিতে কেউ কাজে নিতে চায় না। যার ফলে আমি ফুড ডেলিভারি করে যে উপার্জন করি সেই অর্থ দিয়ে কাজের চুক্তির টাকা, দেশে পরিবারের জন্য সাহায্য ও এখানে নিজের থাকা খাওয়ার অর্থ যোগাড় করতে হচ্ছে। ফলে মানসিক ও অর্থনৈতিক চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। দ্রুত বৈধতা পেয়ে একজন বৈধ অভিবাসী হিসেবে রোমে বসবাসের স্বপ্ন দেখছেন এই বাংলাদেশি অভিবাসী।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে একজন অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন বাংলাদেশি অভিবাসী ইমরান আহমেদ রুমি। অনেকের মতো মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে এক পর্যায়ে ইউরোপে থিতু হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। তাই কাতার থেকে স্পেনে আসেন। স্পেনে এসে বৈধতা ও চাকরি নিয়ে তেমন কোনো সুযোগ না দেখে বেছে নেন ইউরোপের আরেক দেশ পর্তুগালকে। পর্তুগালে তিনি প্রাথমিক বৈধতার নথিভুক্ত হওয়ার কাজ সম্পন্ন করলেও সেখানে একটি চাকরি যোগাড় করতে ব্যর্থ হন। ইমরান বলেন, মাদ্রিদ থেকে লিসবনে গিয়ে সেখানে কিছুদিন থেকেও চাকরি যোগাড় করতে পারিনি। বন্ধুর পরামর্শে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ইতালির রোমে চলে আসি। তিনি আরও বলেন, ইতালিতে এখন আমি একজন আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে অবস্থান করলেও সরকার থেকে কোনো অর্থনৈতিক সহায়তা পাচ্ছি না। বর্তমানে জীবিকা নির্বাহ ও বাসা ভাড়া দিতে আমি ফুড ডেলিভারির কাজ করি। গড়ে দিনে আট ঘণ্টা কাজ করে থাকি। নিজের থাকা-খাওয়া ছাড়াও প্রতি মাসে পরিবারের জন্যেও টাকা পাঠাতে হয়। তাই আশ্রয়প্রার্থী থেকে যদি ইতালিতে বৈধ হতে পারেন, তবে ভবিষ্যতে ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।

রেসিডেন্স পারমিট নবায়নে জটিলতা কথা হয় বাংলাদেশি অভিবাসী জিয়াউর রহমানের সঙ্গে। বাংলাদেশের ফরিদপুর থেকে ২০১৩ সালে রোমে আসেন তিনি। দীর্ঘ পাঁচ বছর ইতালিতে থাকার পর ২০১৮ সালে বৈধতা পান এই অভিবাসী। দুই বছর মেয়াদি কার্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ায় সেটি নবায়নের জন্য জমা করলেও এখনও নতুন পারমিট হাতে পাননি তিনি। জিয়াউর রহমান বলেন, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কার্ড নবায়নের আবেদন করে দীর্ঘদিন পর বায়োমেট্রিকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়ছিলাম। সেটি সম্পন্ন করলেও এখনও নতুন কার্ড হাতে পাইনি। যার কারণে সমস্যা সমাধানে একজন আইনজীবীর সহায়তা নিয়ে ইমিগ্রেশন কার্যালয়ে এসেছি। আশা করছি দ্রুত নতুন রেসিডেন্স পারমিট হাতে পাব। ইমিগ্রেশন কার্যালয়ের সামনে তার মতো অনেকেই ভিড় করেছেন নানা প্রশাসনিক জটিলতা নিয়ে। অভিবাসন সংস্থা আরচির এক কর্মকর্তা বলেন, ইতালির সার্বিক আশ্রয় ব্যবস্থার জটিলতা দূর করতে অনেক জনবলের প্রয়োজন। কিন্তু সরকারের এটি নিয়ে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। যারা ভুক্তভোগী হচ্ছেন নতুন আশ্রয়প্রার্থী থেকে শুরু করে সব নিয়মিত ও অনিয়মিত অভিবাসীরা।
অভিবাসন বিরোধী হিসেবে পরিচিত ২০২২ সালের অক্টোবরে ক্ষমতায় আসা বর্তমান কট্টর ডান জোটের সরকার। ফ্রান্সসহ বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে দেশটি এরই মধ্যে অভিবাসন সমস্যা নিয়ে কূটনৈতিক বিবাদে জড়িয়েছে। সম্প্রতি ভূমধ্যসাগরে মানবিক উদ্ধার জাহাজের কার্যক্রম নিয়ে নতুন ডিক্রি জারি করে আলোচনায় এসেছে জর্জা মেলোনির সরকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *