ইফতার ও সেহরিতে দেশে বিদেশে
ইফতারের রোজাদারের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত। বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে পবিত্র সিয়াম সাধনার মাস মাহে রমজান। এ সময় আল্লাহতাআলা তাঁর রোজাদার বান্দাদের দোয়া কবুল করেন এবং ইফতারের মাধ্যমেই একজন রোজাদার তাঁর রোজা সম্পন্নের পর মহান আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন করেন।
রমজান মাসে ইবাদত করলে সত্তর গুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। রমজানের তিন দশককে তিন ভাগে ভাগ করা হয়ে। প্রথম দশক রহমত। দ্বিতীয় দশক মাগফিরাত। আর তৃতীয় দশক নাজাত। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয় হলো রমজান মাসের রোজা। রোজা হলো সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার, পঞ্চইন্দ্রিয়ের দ্বারা গুনাহের কাজ ও যৌনসঙ্গম থেকে বিরত থাকা।
আমাদের প্রিয় নবী (সা.) খেজুর ও কয়েক ঢোঁক পানি দিয়েই ইফতার শুরু করতেন। সময়ের পরিবর্তনে তাতে যোগ হয়েছে হরেক রকম খাবার। বিভিন্ন দেশে ইফতার ও সেহরির ধরন বিভিন্ন রকম। সব দেশের ইফতারে ফল, জুস, খেজুর, পানি, দুধ বেশ প্রচলিত। সাধারণত এগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয় স্থানীয় কোনো কোনো আইটেম। সেহরিতে রাতের হালকা খাবারই বেশি পরিবেশন করা হয়। আসুন আমরা জেনে নিই পৃথিবীজুড়ে মুসলিমরা কীভাবে রমজান পালন করে। আবার অঞ্চলভেদে একই দেশে হয়ে থাকে বিভিন্ন রকম ইফতার ও সেহরি।
বাংলাদেশ:- উপমহাদেশে আসা এবং শাসন করা জাতি গোষ্ঠীর নানা ধরনের সংস্কৃতির মতো খাবারও এখন এই অঞ্চলের মানুষের খাদ্য তালিকায় মিশে গেছে। রমজান মাসে বাংলাদেশের ইফতারে আখের গুড়ের শরবত,বিভিন্ন ফল ও ফলের রস, বিভিন্ন রঙ মিশ্রিত বাহারি শরবত দিয়ে ইফতারিতে অনেকে পানীয় হিসেবে রাখেন, খেজুর, জিলাপি, পেঁয়াজু, বেগুনি, ছোলা, মুড়ি, চপ, হালিম, বিরিয়ানি, শরবত এবং মাংসের তৈরি কাবাবসহ নানা মুখরোচক খাবার অনেকটা যেন অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। আবার অনেকেই চিকেন ফ্রাই, পিজ্জা, বারবিকিউ, শামি কাবাব, সুতি কাবাব, শাহি জিলাপির পাশাপাশি বিভিন্ন মুখরোচক খাবার-বিরিয়ানি, তেহারি ও ভুনা খিচুড়ি তাদের খাবারের রাখেন।
ভারত:- সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর এখানকার একেক রাজ্যের ইফতারির আয়োজন একেক রকম। যেমন হায়দরাবাদের লোকজনের খাবারের তালিকায় থাকে হালিম, কলকাতার ইফতারে থাকে খেজুর ও বিভিন্ন ধরনের ফল এবং চিকেন শর্মা, বটি কাবাব, কাটলেটের মতো মুখরোচক খাবার। অন্যদিকে দক্ষিণ ভারত বিশেষ করে তামিলনাড়ু ও কেরালায় ইফতারের প্লেটে থাকে ননবো কাঞ্জি নামের এক ধরনের খাবার। ভারতের মুসলিমরা সাধারণত মুঘল আমলের ঐতিহ্যবাহী খাবার দিয়ে ইফতার করতে পছন্দ করে।
পাকিস্তান:- ইফতারের টেবিল সাজাতে থাকে হরেক রকমের খাবার। রুটি এবং মাংস পাকিস্তানীদের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। রমজানের ইফতারের ক্ষেত্রেও এ খাবারটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া ইফতারের টেবিল সাজাতে আরও গুরুত্ব পায় টিক্কা সমুচা, ব্রেড রোল, চিকেন রোল, তান্দুরি কাটলেট, নুডুলস কাবাব, সুফিয়ানী বিরিয়ানি, গোলাপী কাবাব ইত্যাদি। মিষ্টান্ন হিসেবে বিভিন্ন খাবার স্থান পায় সেদেশের ইফতার টেবিলে। যেমন- বিভিন্ন ধরনের ফলমূল, সালাদ, করাচি ফালুদা ইত্যাদি। ঝাল জাতীয় খাবারের মধ্যে রয়েছে নিমকি, সমুচা পরোটা ইত্যাদি। মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে পাকিস্তানে রমজান মাস পালন করা হয় বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে।
আফগানিস্তান:- মান্টু নামে আরেকটি বিশেষ পদ থাকে। এটি মূলত ভাপে রান্না করা পেঁয়াজ আর মুরগির পুর ভর্তি ডাম্পলিং। আফগানিদের ইফতার তালিকায় থাকে একধরনের বিশেষ স্যুপ বা সুরওয়া, ভেড়ার মাংসের দোপেঁয়াজা, কোরমা-এ-মুরগ বা মুরগির কোর্মা, কোর্মা-এ-গোশফান্দ বা খাসির কোরমা, বিভিন্ন ধরনের পাকোড়া, মিষ্টি হিসেবে শিরনি বা খোরমা ইত্যাদি খাবার। এছাড়াও নামে ও স্বাদে আফগানি আমেজ বজায় রাখতে ইফতারে বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে কাবুলি পোলাও থাকবেই।
সৌদি আরব:- একে অপরে দেখা হলেই ‘শাহরু আলাইকা মোবারাকা’ বলে কুশল বিনিময় করেন। মহিমান্বিত রমজান মাস পালনে সৌদিতে মাস দুয়েক আগ থেকে চলে প্রস্তুতি। ক্রয়-অক্ষম মানুষদের জন্য বাদশার পক্ষ থেকে দেওয়া হয় গিফট বক্স। যাতে থাকে তেল-চিনি-দুধসহ অন্যান্য দ্রব্য। রমজান উপলক্ষে কোম্পানি গুলো তাদের জিনিসে উপর থাকে বিশেষ ছাড়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য থাকে হাতের নাগালে। আর সৌদি আরবের লোকেরা পুষ্টিকর খাবারকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সৌদি আরবের ইফতার আয়োজন বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। সেখানে ইফতারে যে খাবারগুলো সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো উন্নত মানের খেজুর, বিভিন্ন ধরনের স্যুপ, ভিমতো (আঙ্গুর রসের শরবত), তামিজ (একধরনের রুটি), বোরাক (মাংসের পিঠা), মানডি (ভাত ও মুরগির মাংসের সমন্বয়ে তৈরি এক ধরনের খাবার) লাবাণ ইত্যাদি। ইফতারের টেবিলে খাবসার গুরুত্ব থাকে সবচেয়ে বেশি। খাবসা নামক একটি খাবার সৌদি আরবে বেশ জনপ্রিয়। সাধারণত মুরগি কিংবা ভেড়ার মাংস দিয়ে তৈরি করা হয়। হজমে উপাদেয় সুরুয়া জাতীয় খাবার শরবা। এটি খেতে হয় রুটির সাথে, শরবা ইফতারিতে এটি রুচিবর্ধক হিসেবে কাজ করে।
কাতার:- প্রতি বছর রমজান মাসের ১৪ তারিখ কাতারে শিশুদের নিয়ে পালন করা হয় ভিন্নধর্মী আয়োজন গারাংগাও। এই দিন শিশুরা কাতারের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে মাগরিবের নামাজের পর ব্যাগ নিয়ে গারাংগাও গান গায় এবং বাড়ির আশপাশে ঘুরে বেড়ায়। মূলত শিশুদের রোজা রাখার প্রশংসা করতে ও তাদের উৎসাহী করতে এই আয়োজন করা হয়ে থাকে। কাতারের বহুল জনপ্রিয় একটি স্বাস্থ্যকর খাবার হারিস। মাংসের টুকরা মিলিয়ে গম সিদ্ধ করে রান্না হয় হারিস। এটি কেননা রোজাদারদের বেশ ক্যালোরি জুগিয়ে থাকে। তাছাড়া খাবারটি উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল ও ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্যে উপকারী।
মালয়েশিয়া:- মালয়েশিয়ার লোকদের একটি স্থানীয় ইফতারে আইটেমের নাম হচ্ছে ‘বারবুকা পুয়াসা’। এটা আখের রস এবং সোয়াবিনের দুধ দ্বারা তৈরি একধরনের বিশেষ মিষ্টান্ন সামগ্রী। এছাড়া মালয়েশিয়ার ইফতারে থাকে নাসি আয়াম, পপিয়া বানাস, আয়াম পেরিক, লেমাক লাঞ্জা ইত্যাদি।সঙ্গে বিভিন্ন স্থানীয় খবর তো আছেই। মালয়েশিয়ায় সাধারণত শুকনো খাবার বা খেজুর দিয়ে মুসলমানেরা রোজা ভাঙে। এছাড়া দেশীয় কিছু বিখ্যাত ইফতার আইটেম তো থাকবেই। মালয়েশিয়ায় মসজিদ থেকে রোজাদারদের ‘বুবুর ল্যাম্বাক’ নামক একটি খাবার বিনামূল্যে দেওয়া হয়। চাউল, মাংস, নারিকেলের দুধ, ঘি ইত্যাদি দিয়ে বুবুর ল্যাম্ব্যাক তৈরি করা হয়। প্রায় পাঁচ দশক আগে কুয়ালালামপুর কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে এই খাবারটি বিতরণের প্রচলন শুরু হয়।
ইরান:- শিয়া অধ্যুষিত মুসলিম দেশটি ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য এবং আনন্দ উদ্দীপনার মাধ্যমে রমজান মাস পালন করে। ইরানের ইফতার সামগ্রীতে ফলমূল এবং মিষ্টান্ন সামগ্রী একটু বেশি গুরুত্ব পায়। দেশটিতে ইফতার সামগ্রীতে ফল হিসেবে খেজুর, আপেল, চেরি, আখরোট, তরমুজ, তেলেবি, আঙ্গুর, কলা গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখযোগ্য সামগ্রীর মধ্যে মধু, পনির, দুধ, রুটি, চা। সবচেয়ে বড় ইসলামিক প্রজাতন্ত্র এছাড়া ইরানের রয়েছে ঐতিহ্যবাহী জিলাপি। পাশাপাশি ‘শোলে জার্দ’ নামক একটি খাবার বেশ জনপ্রিয়। চিনি, ছোট চাল, আর জাফরান দিয়ে এই খাবারটি রান্না করা হয়।
সুদান:- ইফতারি সাধারণত খেজুর দিয়ে শুরু করা হয়। তা ছাড়া ‘হামড়া’ ‘লাহমা’ নামক গোশত দিয়ে তৈরি খাদ্য খেয়ে থাকে। চালের তৈরি ‘আছিদা’ এক ধরনের পিঠা তারা খায়। গোশত ও সস দিয়ে তৈরি ‘মুলাহ’ নামক খাদ্যও ইফতারিতে খায় এবং একই সঙ্গে ‘গাওয়া’ নামক চা জাতীয় পানীয় তারা পান করে। সুদানিরা ‘শোরবা’ নামক স্যুপ, মাংস দিয়ে তৈরি ‘মুহাম্মার’ নামক খাবার, দুধ ভাত দিয়ে তৈরি ‘রুসবিল হালিব’ সালাদ দিয়ে খায়। তদুপরি পায়েশ, ক্ষির, ফিরনি এগুলো তৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে থাকে।
মিসর:- ইফতারে ঐতিহ্যবাহী পানীয় ‘শরবত কামার আল দীন’ সব বয়সীরা পান করে থাকে। মিশরীয় পরিবারের ইফতারে আইটেমে ফুল মুদাম্মাস নামক একটি খাবার থাকে, যা রুটি দিয়ে খাওয়া হয়। প্রধান ইফতার সামগ্রীর মধ্যে আরো রয়েছে কোনাফা ও কাতায়েফ (আটা, মধু, বাদাম ও কিসমিসের সমন্বয়ে তৈরি কেক জাতীয় খাদ্য বিশেষ), ককটেল খুশাফ, মলোকিয়া, খেজুর ইত্যাদি। ইফতারের টেবিলে মিশরের বিখ্যাত একটি পানীয় হচ্ছে ‘কামার আল দিনান্দ আরাসি’। শুকনা আখরোট সারাদিন পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। এরপর এর সঙ্গে মধু মিশিয়ে তৈরি করা হয় কামার আল দিনান্দ আরাসি। ‘খাবোস রমজান’ নামক একধরনের রুটি মিশরে বেশ জনপ্রিয়। জোহরের সালাতের পর থেকে ‘বাজারের শহর’নামে খ্যাত রাজধানী কায়রো শহরের অলিগলিতে ঢাকার চকবাজারের মতো ছড়িয়ে পড়ে হরেক রকম ইফতারের আয়োজন।
মরক্কো:- মরক্কোয় ইফতারকে বলা হয় এফতোর। মরক্কোর অধিবাসীরা একটু বেশি সময় নিয়ে ইফতার করে থাকে। ইফতারে থাকে ঐতিহ্যবাহী খাবার যেমন রিজ্জা, ক্রাচেল, মিস্সামেন, হারিরা, ব্রিওয়াত, স্টিল্লা, হারশা, স্যাল্লো, রিজ্জা। মরক্কোতেও নাফর নামে পরিচিত একদল মানুষ পালন করে সেহরিতে মানুষদের জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব। মাথায় টুপি, পায়ে জুতা আর মরক্কোর ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিত হয়ে, সুরেলা গলায় প্রার্থনা সংগীত গেয়ে শহরের অলিগলিতে হেঁটে তারা মানুষকে জাগিয়ে তোলে। রমজানে তাদের রাস্তাগুলো পরিণত হয় খাবারের বাজারে। রমজানের শেষে নাফরদের পুরস্কৃত করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র:- আমেরিকায় ইফতারসামগ্রীর মধ্যে খেজুর, খোরমা, সালাদ, পনির, রুটি, ডিম, গোশত, ইয়াগার্ট, হট বিনস, স্যুপ, চা ইত্যাদি থাকে। রমজান মাসে হোয়াইট হাউসে ইফতার পার্টি প্রথম শুরু করেছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। বর্তমানে একটি প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কানাডা:- রমজানে ইফতার পার্টির আয়োজন চলে মহাসমারোহে এবং প্রতি শনিবার অটোয়া ইসলামিক সেন্টারের ইফতার পার্টিতে দেশ- বিদেশের অসংখ্য মুসলমান হাজির হন। ইফতারিতে খেজুর, খোরমা, পনির, সালাদ, ফল, স্যুপ, জুস, রুটি, ডিম, গোশত, চা-কফি ইত্যাদি থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘দ্য মুসলিম স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন ইফতার পার্টির আয়োজন করে।
ইতালি:- ইফতারিতে তারা বার্গার জাতীয় খাদ্য, নানাবিধ ফল যেমন- মাল্টা, আপেল, আঙ্গুর, বিভিন্ন ফলের রস খান। সেহেরিতে বার্গার ও বার্গার জাতীয় খাদ্য বেশি পছন্দ করে থাকে। আছে। সমগ্র জনসংখ্যার ১% হলো মুসলমান। অল্পসংখ্যক মুসলমানও রমজানকে ঘটা করে স্বাগত জানায়।
100% Right Information
ধন্যবাদ আপনাকে