সব ভূমিতে কেন তেল বা মূল্যবান খনিজ পাওয়া যায় না
স্বর্ণ বা হীরার মতো ধাতু কেন পাওয়া যায় না আমাদের দেশে। স্বর্ণের বিষয়টা কী? আসলে, মাটির আরও অনেক অনেক গভীরে থাকে লোহা, স্বর্ণ বা এ ধরনের ধাতুগুলো, কিন্তু অত গভীর নয় বাংলাদেশের ভূখণ্ড বা বঙ্গীয় ব-দ্বীপ অঞ্চল। কীভাবে মাটির নিচে তেল তৈরি হয়, কেন সব দেশে বা সব ভূমিতে তেমন তেল বা মূল্যবান খনিজ পাওয়া যায় না। কেউ হয়তো জিজ্ঞেস করতে পারেন কয়লা, গ্যাস বা তেল পাওয়া যায়।
সব ভূমিতে কেন তেল বা মূল্যবান খনিজ পাওয়া যায় না
কীভাবে মাটির নিচে তেল ও গ্যাস তৈরি হয়? সম্প্রতি তেলের সন্ধান পাওয়া গেছে সিলেট গ্যাসক্ষেত্রে। সব দেশে বা সব ভূমিতে কেন তেমন তেল বা মূল্যবান খনিজ পাওয়া যায় না? জেনে নিন…
সম্প্রতি সিলেট গ্যাসক্ষেত্রের প্রথম স্তরে তেলের সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১৫৯ লিটারের মতো তেলের প্রবাহ পাওয়া গেছে এই গ্যাসক্ষেত্রে। এবং তিনটি স্তরে নতুন গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে বলেও জানা গেছে সম্প্রতি।
এসব খবর দেখে আপনার মনে নানা প্রশ্ন জাগতে পারে। কেমন করে বা কীভাবে মাটির নিচে তেল তৈরি হয়, কেন সব দেশে বা সব ভূমিতে তেমন তেল বা মূল্যবান খনিজ পাওয়া যায় না। কেউ হয়তো জিজ্ঞেস করতে পারেন কয়লা, গ্যাস বা তেল পাওয়া যায়। কিন্তু স্বর্ণ বা হীরার মতো ধাতু কেন পাওয়া যায় না আমাদের দেশে।
এই সব প্রশ্ন, একটু জানা যাক কয়লা বা তেল-গ্যাস ইত্যাদি কীভাবে তৈরি হয়।
আমাদের অতি পরিচিত বা প্রচলিত শব্দ ইংরেজিতে যাকে বলে বাজ ওয়ার্ড। সে হিসেবে জীবাশ্ব জ্বালানি ইংরেজিতে বলা হয় ফসিল ফুয়েল। এই ইংরেজি শব্দ ‘ফসিল’ বা বাংলা ‘জীবাশ্ব’ কথাটার মানে জীবের অবশেষ। বহু বছর আগে বেঁচে থাকা উদ্ভিদ ও প্রাণী, অর্থাৎ জীব মৃত্যুর পর বা কালের আবর্তে মাটির নিচে চাপা পড়েছে। প্রচণ্ড তাপ বা চাপে এগুলো পরিণত হয়েছে জীবাশ্বে। নিশ্চয়ই ভাবছেন কত বছর আগের।
আরও পড়ুন: ঘূর্ণিঝড় কেন হয় কিভাবে তৈরি হয়?
যেমন কয়লা, ডাইনোসরদের চেয়েও প্রাচীন জীবের অবশেষ। ডাইনোসরদের মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৬৫ মিলিয়ন বা সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে। এর আরও আগের মৃত গাছ বা প্রাণিদেহের অবশেষ মাটির নিচে চাপা পড়তে পড়তে কালের আবর্তে অনেক নিচে নেমে গেছে। আবার মহাদেশীয় পাতের ভাঙন বা নড়াচড়ার ফলে এগুলো উঠে এসেছে কিছুটা উপরের দিকে।
ওদিকে সমুদ্রের পানিতে প্ল্যাঙ্কটন বা জলজ ক্ষুদ্র প্রাণী থাকে। এগুলোর ইতিহাস পৃথিবীর মতোই প্রাচীন কোটি কোটি বছর ধরে এসব জীবের দেহাবশেষ, অর্থাৎ কার্বন বা অন্য জৈব যৌগ সমুদ্রের তলদেশে গিয়ে পড়েছে। আবার এর ওপর মাটি আর পলি পড়েছে। যত দিন গেছে এর ওপর আরও পলি, আরও মাটি জমেছে। কালের আবর্তে এগুলো ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে পাথরে। ওসব পাথর জমাট জীবের দেহাবশেষ থেকে অক্সিজেনহীন পরিবেশে তৈরি হয়েছে মোমের মতো একধরনের পদার্থ, যার নাম কেরোজেন।
কেরোজেন একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অন্তত ২ থেকে তিন কিলোমিটার মাটির নিচে চাপা পড়লে পৃথিবীর ভেতরের তাপ আর কোটি কোটি বছর জমা মাটির চাপে পরিণত হতে পারে তেল বা গ্যাসে। তবে এখানে বোঝা প্রয়োজন মাটির যত গভীরে, তাপমাত্রা আর চাপ তত বেশি হয়। যার উপর নির্ভর করে তৈরি হবে তেল নাকি গ্যাস, নাকি দুটোই। যদি তাপমাত্রা ৯০-১৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে গ্যাস আর তেল (পেট্রোলিয়াম) দুটোই তৈরি হবে। তবে তাপমাত্রা ১৬০ ডিগ্রির বেশি হলে তৈরি হবে শুধু গ্যাস। তো বোঝাই যাচ্ছে কারণটা, তাপে তরল হয়ে গেছে বাষ্পীভূত।
কী ঘটেছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে? ১৫/২০ কিলোমিটার বা আরও বেশি পলি মাটির নিচে চাপা পড়ে, প্রচণ্ড তাপে ঝলসে গিয়ে তৈরি হয়েছে এসব জীবাশ্ব জ্বালানি। কোন স্থানে ২/৩ কিলোমিটার, আবার কোথায় ১৫-২০ কিলোমিটার। এত নিচে চাপা পড়লে তাপও তো অনেক বেশি। ফলে প্রাকৃতিক গ্যাস ও কিছু পেট্রোলিয়াম তৈরি হয়েছে আমাদের দেশে।
অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে আসে।
০১. প্ল্যাঙ্কটন, ক্ষুদ্র সামুদ্রিক জীব এগুলো তো সমুদ্রে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের ভেতরে কীভাবে এল?
০২. কোটি কোটি বছরে মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকা এসব জিনিস উঠে এল কীভাবে।
এখন আবার বাংলাদেশ সৃষ্টির ঘটনাটা জানতে হবে। আমাদের দেশ যে মহাদেশীয় পাতের অংশ, তার নাম হলো ভারত মহাদেশীয় পাত। কিন্তু সরাসরি বাংলাদেশ নয়, এ মহাদেশীয় পাতের অংশ বঙ্গীয় ব-দ্বীপ। তবে মহাদেশীয়ে এই পাতটা একসময় ছিল পৃথিবীর উল্টো পাশে, অ্যান্টার্কটিকার কাছে, মাঝে বিশাল সমুদ্র। এবং আজকে যেখানে বাংলাদেশটা দেখা যাচ্ছে, সেখানে ছিল ইউরেশীয় পাত। ভারত মহাদেশীয় এই পাত অতদূর থেকে ভেসে এসে প্রচণ্ড বেগে ধাক্কা খেল ইউরেশীয় পাতের সঙ্গে ভয়ংকর এক ধাক্কা, এই ধাক্কায় তো বিভিন্ন ভূমির স্তর উল্টে-পাল্টে গেল।
এখনও কিন্তু ভূমিকম্পের সময় ওই মহাদেশীয় পাতের নড়াচড়ায় কোনো স্তর উপরে উঠে আসে, কোনোটা নেমে যায়। আবার সেই ভয়ংকর ধাক্কার কথা বলি। সেই প্রচণ্ড ধাক্কায় আজকে যেখানে তিব্বতের পর্বতাঞ্চল, সেটা গড়ে উঠে বা তৈরি হয় হিমালয় পর্বত। তিব্বতের পর্বতাঞ্চল থেকে নদী হয়ে পলি এসে জমা হয় ভারত মহাদেশীয় পাতের সেই অংশটায়, যেখানে আজকের বাংলাদেশ। হ্যাঁ, এই বাংলাদেশের বেশির ভাগ অংশই পলি পড়ে পড়ে তৈরি হয়েছে, আগে এই দেশের বেশির ভাগ অংশ ছিল সমুদ্র।
আরও পড়ুন: পুরনো স্মার্টফোন বিক্রির আগে
তবে সমুদ্র থেকে প্ল্যাঙ্কটন, ক্ষুদ্র পানি এগুলো কীভাবে মাটিতে চাপা পড়ল, তা তো বোঝা গেল। বোঝা গেল, কীভাবে জীবাশ্ব মাটির নিচে চাপা পড়ে পড়ে চাপ ও তাপে কেরোজেন তৈরি হয়, সেখান থেকে পাওয়া যায় তেল ও গ্যাস। আরও কিছু জিনিস আমাদের দেশে পাওয়া যায়। যেমন চুন বা চুনাপাথর।
আবার ভারত মহাদেশীয় পাতের একদম শেষের অংশে, অর্থাৎ দক্ষিণ প্রান্তে রয়েছে বর্তমান সিলেট ও রংপুর। এবং দক্ষিণ প্রান্তে সে সময় ছিল শুধু সমুদ্রের অথৈ জল। সেই সমুদ্রের শামুক, ঝিনুক বা কোরালের মতো প্রাণীরা মারা গেলে খোলসগুলো গিয়ে মেশে যেত পানিতে। খোলসে অন্যতম প্রধান উপাদান ক্যালসিয়াম। যেমন থাকে আমাদের হাড়ে বা নখে। প্রাণিদেহের শক্ত আবরণ মানেই ক্যালসিয়াম। আর চুনাপাথরের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ক্যালসিয়ামই। সেই খোলসে মিশ্রিত পানি বাষ্পীভূত হয়ে গেলে ক্যালসিয়াম পড়ে থাকে। আর এসব ক্যালসিয়াম জমে জমে তৈরি হয়েছে চুনাপাথর। সিলেটের অংশটা তো সমুদ্রের প্রান্তে, যেখানে গভীরতা কম বা এককালের উপকূল। সেটাই আজকের সিলেট তাই সেখানে অত সাদাপাথর বা চুনাপাথর।
আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি শুধু চুনাপাথরই না, গ্যাস বা পেট্রোলিয়ামও তৈরি হতে পারে এসব অঞ্চলে। এমনটাই হওয়ার কথা, সিলেটের গ্যাসক্ষেত্র তাই রহস্যময় কিছু না।
দেশে প্রথম তেলের সন্ধান পাওয়া যায় ১৯৮৬ সালে সিলেটের হরিপুরে। প্রথম গ্যাসের সন্ধান পাওয়া যায় এরও প্রায় ৩০ বছর আগে ১৯৫৫ সালে এই হরিপুরেই। এই তথ্য রয়েছে সিলেট গ্যাসফিল্ড লিমিটেডের ওয়েবসাইটেই।
আরও পড়ুন: মহাকাশে ৩৬ স্যাটেলাইট পাঠালো ভারত
তেল, গ্যাস, সাদাপাথর বা চুনাপাথর পাওয়ার রহস্যটা বোধহয় বুঝা গেছে। তবে স্বর্ণের বিষয়টা কী? আসলে, মাটির আরও অনেক অনেক গভীরে থাকে লোহা, স্বর্ণ বা এ ধরনের ধাতুগুলো, কিন্তু অত গভীর নয় বাংলাদেশের ভূখণ্ড বা বঙ্গীয় ব-দ্বীপ অঞ্চল। সেই কারণে এ অঞ্চলে স্বর্ণ বা এ ধরনের খনিজ পাওয়া যায় না, তবে কালেভদ্রে কোথাও পাওয়া যেতেও পারে, তা নিতান্ত অল্প এবং ব্যতিক্রম।
এই সব কারণে প্রাকৃতিক গ্যাসই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি। তেল-গ্যাস তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াটা আসলে একই কারণটা আপনি ইতিমধ্যেই জানা হয়েছে।
সূত্র:- উইকিপিডিয়া,সিলেট গ্যাস ফিল্ড লিমিটেড, বঙ্গীয় বদ্বীপের অতীত ও ভবিষ্যৎ/ দীপেন ভট্টাচার্য.
Hi hi
Pingback: বুধ গ্রহে কত দিনে এক বছর হয় - amaderkhabar