ফ্লাইট রেকর্ডার যা সাধারনত ব্ল্যাক বক্স নামে পরিচিত
ব্ল্যাকবক্স হলো মূলত ফ্লাইট রেকর্ডার, যা বিমানে স্থাপন করা হয়। তবে ব্ল্যাকবক্সের নাম ‘ব্ল্যাকবক্স’ হওয়ার কারণ, আগের ফ্লাইট রেকর্ডারগুলো কালো রঙের হতো। দুই ধরনের ব্ল্যাকবক্সে বা ফ্লাইট রেকর্ডার ব্যবহার করা হয়, একটি ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার (FDR), অন্যটি ককপিট ভয়েস রেকর্ডার (CVR)। বিমানের পেছনের দিকে বসানো এই যন্ত্রে প্রায় ২ থেকে ২৫ ঘণ্টার রেকর্ড জমা থাকে।
ফ্লাইট রেকর্ডার যা সাধারনত ব্ল্যাক বক্স নামে পরিচিত
ব্ল্যাকবক্স কি আসলে ব্ল্যাক বা কালোবাক্স। আমাদের মাথায় শব্দটা শুনলে হয়তো কালো রঙের একটা বাক্সের কথা মনে হবে। কিন্তু ব্ল্যাকবক্স কমলা রঙের ধাতব বাক্স। অনেকের মতে, এর ভেতরের অংশটি অন্ধকার হয় বলে এমন নামকরণ আবার কেউ কেউ বলেন, আগে যন্ত্রটি বিমানের সম্পূর্ণ অন্ধকার একটি অংশে বসানো হতো বলেই এমন নাম। যাই হোক, ব্ল্যাকবক্স নামটি শুধু মানুষের মুখে মুখেই প্রচলিত। খাতাকলমে যন্ত্রটির নাম, ফ্লাইট রেকর্ডার। ব্ল্যাকবক্স হলো মূলত ফ্লাইট রেকর্ডার, যা বিমানে স্থাপন করা হয়। তাই এই ইলেকট্রনিক ডিভাইসটি বিমানযাত্রার সবকিছু রেকর্ড করতে ব্যবহৃত হয়। এই ব্ল্যাকবক্স বা ফ্লাইট রেকর্ডার, যাত্রীদের কথাবার্তা, ককপিটে পাইলটদের কথোপকথনসহ সবকিছু রেকর্ড করে।
অর্থাৎ যে যন্ত্র দিয়ে একটি ফ্লাইট বা বিমানযাত্রার উচ্চতা, পাইলটদের কথোপকথন, গতি, ইঞ্জিনের কর্মক্ষমতা, ইঞ্জিনের শব্দ ইত্যাদি রেকর্ড করা হয়, তাই ব্ল্যাকবক্স। ব্ল্যাকবক্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিমান দুর্ঘটনার তদন্তে, বিমান ভেঙে চুরমার হয়ে গেলেও এটি অক্ষত থাকে বা থাকবে।
তবে ব্ল্যাকবক্সের নাম ‘ব্ল্যাকবক্স’ হওয়ার কারণ, আগের ফ্লাইট রেকর্ডারগুলো কালো রঙের হতো। কিন্তু বিমান দুর্ঘটনার পর দুর্ঘটনার স্মৃতি রেকর্ড করার বিষয়টিও এর নামের পেছনে ভূমিকা রেখেছে। আবার একে বিমান বা উড়োজাহাজের শব্দ বা বার্তাধারকও বলা যায়।
আরও পড়ুন: সৌরজগৎ সম্পর্কে কিছু তথ্য
ব্ল্যাকবক্স ১৯৬০-এর দশকে চালু হয়েছিল, যদিও ফ্রাঙ্কোই হুসেনো এবং পল ব্যুডোঁয়ে তাঁদের ‘টাইপ এইচবি’ ফ্লাইট রেকর্ডার দিয়ে ফ্রান্সের ম্যারিগনেন ফ্লাইট টেস্ট সেন্টারে ১৯৩৯ সালে প্রথম এর চেষ্টা চালিয়েছিলেন। তবে এটি ছিল ফটোগ্রাফনির্ভর ফ্লাইট রেকর্ডার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আরও বেশি করে এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব শুরু করে। কিন্তু বিমানের তথ্য সংরক্ষণের জন্য ব্ল্যাকবক্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ব্ল্যাকবক্স বিমানের আকারের ওপর নির্ভর করে বাতাসের চাপ, গতি, জ্বালানি প্রবাহসহ ১১ থেকে ২৯ ধরনের ডেটা রেকর্ড করতে পারে। বিমানের পেছনের দিকে বসানো এই যন্ত্রে [পুরাতন ব্ল্যাকবক্সে] অবশ্য ম্যাগনেটিক টেপ ব্যবহার করা হতো এবং প্রায় ২ থেকে ২৫ ঘণ্টার রেকর্ড জমা থাকে। এ ধরনের ফ্লাইট রেকর্ডার ষাটের দশকে ব্যবহৃত হতো।
সাধারণত দুই ধরনের ব্ল্যাকবক্সে বা ফ্লাইট রেকর্ডার ব্যবহার করা হয়, একটি ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার (FDR), অন্যটি ককপিট ভয়েস রেকর্ডার (CVR)।
এফডিআর (FDR) বিমানযাত্রার বিভিন্ন তথ্য রেকর্ড করে, যেমন উচ্চতা, গতি ও ইঞ্জিনের কর্মক্ষমতা। বিমানের সিস্টেম থেকে অপারেটিং ডেটা রেকর্ডের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক বা বৈদ্যুতিক সিস্টেমে পাঠানো সব ধরনের নির্দেশই এটি রেকর্ড করে। যার কারণে বিমানের বিভিন্ন অংশে তারযুক্ত সেন্সর আছে। আর এগুলো থেকে তথ্য চলে যায় এফডিআরে (FDR)। তাই পাইলট কোনো সুইচ ঘোরালেও সেই তথ্য রেকর্ড হয়ে যায়। বিমানের পেছনের দিকে বসানো এই যন্ত্রে প্রায় ২ থেকে ২৫ ঘণ্টার রেকর্ড জমা থাকে।
পাইলটদের মধ্যে কথোপকথন, ইঞ্জিনের শব্দ ও সতর্কতার মতো অন্যান্য শব্দসহ ককপিটের শব্দগুলি রেকর্ড করে ককপিট ভয়েস রেকর্ডার সিভিআর (CVR) নামের অংশটি দেখেই বোঝা যায়, এটি মূলত ককপিটের তথ্য জমা রাখে। পাইলটদের তথ্য সংগ্রহের জন্য তাদের হেডসেটের পাশাপাশি ককপিটে মাইক্রোফোন সেট করা থাকে। কিন্তু এটি শুধু শেষ ৩০ মিনিটের তথ্য বা অডিও জমা রাখে। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আগের অংশটুকু ডিলিট হয়ে যায়, এবং নতুন তথ্য ওর ওপরেই রেকর্ড হয়ে থাকে।
সাধারণত ব্ল্যাকবক্সের ভেতরে থাকে মেমোরি চিপ বা ম্যাগনেটিপ টেপ। ব্ল্যাকবক্সে প্রচণ্ড চাপে, এমনকি বিমান ভেঙে চুরমার হয়ে গেলে বা কয়েক হাজার ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেলেও অক্ষত থাকে। কিন্তু পানির নিচে তলিয়ে গেলে অবস্থান শনাক্ত করার জন্য আন্ডারওয়াটার লোকেটর বিকন বসানো থাকে। এ এর সাবমার্জ সেন্সর একধরনের শব্দ করে, এই শব্দ শনাক্ত করে ব্ল্যাকবক্সের অবস্থান চিহ্নিত করা যায়। দুর্ঘটনায় পড়ার পর ব্ল্যাকবক্স ৩০ দিন পর্যন্ত শব্দ তরঙ্গ ছড়াতে থাকে। এই শব্দ ২-৩ কিলোমিটার দূর থেকে শনাক্ত করতে পারেন দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞরা। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, ব্ল্যাকবক্স সাগরের ১৪ হাজার ফুট নিচে থেকেও শব্দ পাঠাতে পারে। ব্ল্যাকবক্স এগার হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় প্রায় ১ ঘন্টা এবং ২৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় প্রায় ১০ ঘন্টা টিকতে পারে। বিমানের পেছনের দিকে দুটো যন্ত্রই বসানো থাকে এবং বিমানে থাকা জেনারেটর এগুলোতে পাওয়ার জোগান দেয়।
আরও পড়ুন: বুধ গ্রহে কত দিনে এক বছর হয়
কিন্তু এর আসল বিশেষত্ব হলো ভেতরের ক্র্যাশ সারভাইবাল মেমোরি ইউনিট (CSMU)। সিএসএমইউ তিনটি স্তর রয়েছে ১. অ্যালুমিনিয়াম হাউজিং (অ্যালুমিনিয়ামের আবরণ), ২. হাই টেম্পারেচার ইনসুলেশন (উচ্চতাপ নিরোধক আবরণ) এবং ৩. স্টেইনলেস স্টিল শেল (ইস্পাতের আবরণ)। প্রচণ্ড তাপমাত্রা, আগুন, চাপ ইত্যাদি থেকে অক্ষত রাখার ব্যবস্থা এগুলো। তবে দুর্ঘটনার পর ব্ল্যাকবক্স এর তথ্য পুনরুদ্ধার করা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার যা কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।
বিভিন্ন দুর্ঘটনার পর এই ব্ল্যাকবক্সের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বোঝা গেছে। যেমন কুইন্সল্যান্ডে ১৯৬০ সালে ট্রান্সঅস্ট্রেলিয়া এয়ারলাইনস ফ্লাইট ৫৩৮ দুর্ঘটনার তদন্তের সময় বিচারক বেশ জোর দিয়ে বলেন, অস্ট্রেলিয়ার সব বিমানে ফ্লাইট রেকর্ডার স্থাপন করা উচিত। তাই বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া ককপিটের ভয়েস রেকর্ড করা বাধ্যতামূলক করেছে।
বর্তমানে কিন্তু অনেক গাড়িতেও ব্ল্যাকবক্স যুক্ত করা হচ্ছে। পাশাপাশি ব্ল্যাকবক্স আরও উন্নত করা, ক্যামেরা যুক্ত করা বা ভিডিও রেকর্ডের ব্যবস্থার চেষ্টা করছেন প্রযুক্তিবিদ ও গবেষকরা।
সূত্র:-উইকিপিডিয়া, ফ্লাইজিপস ডটকম, হাউ স্টাফ ওয়ার্কস ডটকম।
Pingback: মজাদার খাবার কেন প্লেনে ভালো লাগে না - amaderkhabar