স্বাস্থ্য ও পুষ্টি

শরীরের জন্য অপরিহার্য খনিজ উপাদান

শরীরের জন্য অপরিহার্য খনিজ উপাদান

বিভিন্ন মিনারেল বা খনিজ উপাদান স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ যেমন- ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম ইত্যাদি। এ ছাড়া আরও কতকগুলো উপাদান আছে যেগুলো সামান্য পরিমাণে হলেও সুস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি।

স্বল্প মাত্রার অথচ পুষ্টিকর এসব উপাদানকেই “এসেনশিয়াল ট্রেস এলিমেন্টস“ বলা হয়। শরীরের ওজনের মাত্র ০.০১% মাত্রায় বিদ্যমান এই “ট্রেস এলিমেন্টগুলো“ শরীরের বিভিন্ন এনজাইম, হরমোন এবং কোষকলার অংশবিশেষ হওয়ায় এগুলোও শরীরের জন্য বেশ  অপরিহার্য।

খাদ্যে অথবা সম্পূরক খাদ্যে প্রয়োজনীয় মাত্রায় এসব উপাদানের অনুপস্থিতিতে মিনারেল ঘাটতি দেখা। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস যেমন- বেশি পরিমাণে  টিনজাত বা প্রক্রিয়াজাত খাদ্য গ্রহণ, খাদ্য তালিকায় শাক-সবজি বা ফলমূলের পরিমাণ কম থাকা, কম-ক্যালরিযুক্ত বা নিয়ন্ত্রিত খাদ্য গ্রহণ, নিরামিষাশী, খাদ্য হজমজনিত রোগ, কোনো কারণে সঠিক পর্যায়ে খাদ্য শোষণে ব্যর্থতা, খাদ্যে  বিভিন্নঅ্যালার্জি বা দুগ্ধশর্করায় (ল্যাকটোজ) অসহনীয়তা ইত্যাদি কারণেও এ ধরনের রোগ দেখা দিতে পারে।

জিঙ্ক বা দস্তা:- শরীরের বিভিন্ন বিপাকীয় পদ্ধতি যেমন আমিষ সংশ্লেষণ, রোগ-প্রতিরোধক কার্যাবলী, কোষ বিভাজন ও ডিএনএ সংশ্লেষণ, ক্ষত থেকে আরোগ্য লাভের প্রক্রিয়া, টেসটোসটেরন জাতীয় পুরুষ হরমোন তৈরি, মেলাটোনিন তৈরি ইত্যাদি প্রক্রিয়াগুলোকে প্রভাবিত করে থাকে এই জিঙ্ক বা দস্তা। এছাড়াও গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের সঠিক বিকাশ ও বৃদ্ধি লাভের ক্ষেত্রে এবং শিশু বয়সে এবং বয়োসন্ধিকালে শরীরের বৃদ্ধি ও পূর্ণতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই উপাদানটি। জিঙ্ক বা দস্তা অভাবে স্মৃতিশক্তি হ্রাস, রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে ডায়রিয়া, ঘন ঘন ঠাণ্ডা লাগা, ঘুমের সমস্যা, খাদ্যে অরুচি এবং খাদ্যের স্বাদ ও গন্ধ অনুভবের ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, চুল পড়া, ত্বকের ক্ষতি ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। জিঙ্ক বা দস্তা অতিমাত্রার  ঘাটতি থেকে হতবুদ্ধিতা জাতীয় মানসিক প্রতিবন্ধকতা, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা এবং যৌন অক্ষমতা দেখা দেয়ার আশংকা থাকে।

হাঁস-মুরগির মাংস, লাল মাংস, ঝিনুক ইত্যাদি প্রাণিজাতীয় ও দুগ্ধজাতীয় খাদ্য, ডার্ক চকলেট, বাদাম, শিম জাতীয় উদ্ভিদ ইত্যাদিতে এই উপাদানটি পাওয়া যায়। জিঙ্কের একটি ভালো উৎস হলো মিষ্টি কুমড়ার বিচি।

লোহা:- একটি ক্ষুদ্র উপাদান যার পরিমাণ শরীরের ওজনের মাত্র ০.০০৪%। রক্তস্থ হিমোগ্লোবিন শরীরের কোষকলা গুলোতে শক্তি ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে। হিমোগ্লোবিন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে যদি শরীরে প্রয়োজনের তুলনায় কম লোহা থাকলে। লোহা অথবা হিমোগ্লোবিনের ঘাটতিকেই শরীরে রক্তশূন্যতা বলা হয়। শরীরে দুর্বলতা দেখা দেয় এবং শরীর সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে লোহার ঘাটতিতে। এমনকি  রক্তশূন্যতার কারণে হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটতে পারে। স্বল্প মাত্রার লোহার ঘাটতি থেকে মস্তিষ্কের বুদ্ধিমত্তার ব্যাঘাতও সৃষ্টি হতে পারে। আমাদের দেশে গর্ভকালীন মাতৃ মৃত্যুর প্রধান কারণ রক্তশূন্যতা। পুরুষ ও বয়স্ক মহিলাদের জন্য প্রতিদিন ৮ মিলিগ্রাম এবং অল্প বয়স্ক মহিলাদের জন্য প্রতিদিন ১৮ মিলিগ্রাম লোহার প্রয়োজন হয়। সীমজাতীয় সবজি, বাদাম, মাংস, কলিজা, সম্পূর্ণ শস্যদানা যেমন; বাদামি চাল, ঝিনুক, কলা, আপেল, গাঢ় সবুজ শাক-সবজি ইত্যাদি খাদ্য থেকে আয়রন পাওয়া যায়।

সেলেনিয়াম:- শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় অপর একটি “ট্রেস এলিমেন্ট“ সেলেনিয়াম। শরীরের প্রায় দু’ডজনেরও বেশি সেলেনোপ্রোটিনের মধ্যস্থ একটি উপাদান হচ্ছে সেলেনিয়াম যে উপাদানটি থাইরয়েড হরমোনের বিপাকীয় কার্যক্রম, প্রজনন ক্ষমতা, ডিএনএ-র সংশ্লেষণজনিত প্রক্রিয়াগুলোকে প্রভাবিত করা ছাড়াও জারণ প্রক্রিয়ায় সংঘটিত কোষকলার ক্ষতি এবং রোগের সংক্রমণ রোধে ভূমিকা পালন করে। সেলেনিয়াম অভাবে মানসিক প্রতিবন্ধতা, হৃদপিণ্ডের সমস্যা, মাংসপেশীতে ব্যথা বা মাংসপেশীর দুর্বলতাও দেখা দিতে পারে। প্রতিদিনের চাহিদা ৫৫ মাইক্রো গ্রাম মাত্র। মাছ, গরু-ছাগলের মাংস, হাঁস-মুরগির মাংস এবং ডিম, শস্যদানা, বাদাম এবং বীজজাতীয় খাদ্য থেকেই প্রতিদিনের জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রায় সেলেনিয়াম পাওয়া যায়। নখ এবং চুল বিশ্লেষণ করে শরীরে বিদ্যমান দীর্ঘমেয়াদি সেলেনিয়ামের মাত্রা বিশ্লেষণ করা যায়।

ক্যানসার রুখে দেবে 

আয়োডিন:- থাইরয়েড থেকে নিঃসৃত এই হরমোনটি থাইরয়েড গ্রন্থির সঠিক পরিচালনার জন্য আয়োডিন প্রয়োজনীয়। খাদ্যকে শক্তিতে রূপান্তরিত করা, কোষকলার বিপাকীয় কার্যকলাপ পরিচালনা, অতিরিক্ত চর্বির বিপাকীয় ব্যবহার, ইস্টোজেন জাতীয় হরমোনকে নিয়ন্ত্রণ করা, শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, মানসিক ক্ষিপ্রতা এবং বোধশক্তির উন্নতি সাধন ইত্যাদি ক্ষেত্রে এই হরমোনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৫০ বছরের ঊর্ধ্বে মহিলাদের এবং গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে সাধারণত এই হরমোনটির ঘাটতি হতে দেখা যায়। আয়োডিন ঘাটতির প্রধান লক্ষণ গলগণ্ড রোগটি।  ‘হাইপোথাইরয়েডিজম’ রোগ দেখা দেয় দীর্ঘদিন ধরে থাইরয়েড গ্রন্থি প্রয়োজনীয় মাত্রায় আয়োডিন ঘাটতি হলে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই ধরনের ঘাটতি থেকে ‘ক্রিটেনিজম নামক’ বিপজ্জনক অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, শিশু শারীরিক এবং মানসিক প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়ে পড়ে। ১-৮ বছরের শিশুর প্রতিদিনের চাহিদা ৯০ মাইক্রোগ্রাম, ৯-১৩ বছর পর্যন্ত ১২০ মাইক্রোগ্রাম এবং ১৪ বছর থেকে আরম্ভ করে বয়স্কদের জন্য তা ১৫০ মাইক্রোগ্রাম। সামুদ্রিক বিভিন্ন উদ্ভিদ, মাছ ও অন্যান্য খাদ্য, ডিম, দুধ এবং আয়োডিনযুক্ত লবণ আয়োডিনের প্রধান উৎস।

তামা:- তামা বিভিন্ন প্রকার আমিষ, এনজাইম এবং শ্বাসতন্ত্র সংক্রান্ত কোষকলার মধ্যস্থ এনজাইমগুলোর একটি উপাদান যা শারীরিক বিকাশ এবং বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তামা রক্তের হিমোগ্লোবিনের লোহা সংযুক্তিতে, ত্বকের স্বাভাবিক রং ধরে রাখতে, স্নায়ুর সংকেত আদান-প্রদানে, পরিপাকতন্ত্র, বিপাকীয় কার্যক্রম এবং রোগ-প্রতিরোধক কার্যক্রম পরিচালনায় অবদান রাখে তামা। তামার স্বল্পতা দেখা যায় অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুরা এবং রক্তশূন্যতায় আক্রান্তদের ক্ষেত্রেও। তামার অভাবে রক্তে শ্বেতকণিকার স্বল্পতা, হাড়ের সমস্যা, অনিয়ন্ত্রিত হৃদস্পন্দন, রোগ-প্রতিরোধক তন্ত্রের সমস্যা এবং চুল ও নখের বৃদ্ধিতে সমস্যা দেখা দেয়। বাদাম, শিম বা মটরজাতীয় বীজ, শাক-সবজি, ফলমূল, গরু বা খাসির যকৃত, সামুদ্রিক খাদ্য ইত্যাদিতে এই উপাদানটি পাওয়া যায়। প্রতিদিনের জন্য প্রয়োজন মাত্র ৯০০ মাইক্রোগ্রাম। গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মায়েদের জন্য মাত্রাটা বেশি হওয়াটা ভালো।

কোবাল্ট:-  ভিটামিন বি-১২ এর একটি উপাদান, কোবাল্টের ঘাটতি মানে ভিটামিন বি-১২ এরই ঘাটতি। প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় মাত্রা মাত্র ০.০০০১ মিলিগ্রাম। কোবাল্ট অস্থিমজ্জার কোষকলাকে উজ্জীবিত করে লোহিত রক্তকনিকা তৈরিতে সাহায্য করে, থাইরয়েড কর্তৃক আয়োডিন শোষণে বাঁধা প্রদান করে এবং বিভিন্ন ধরনের এনজাইমের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে। কোবাল্ট অভাবে জটিল ধরনের রক্তশূন্যতা, শারীরিক ক্লান্তি ও দুর্বলতা, কোনো কোনো অঙ্গের বিশেষ করে হাত ও পায়ের দুর্বলতা ও অসাড়তা অনুভব করা, বমিভাব, মাথাব্যথা, মানসিক বিভ্রমতা, পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা, ওজন হ্রাস, থাইরয়েড গ্রন্থি বড় হয়ে যাওয়া, হৃদযন্ত্রের সমস্যা, স্নায়বিক সমস্যা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। দীর্ঘদিনের ঘাটতি থেকে স্নায়বিক সমস্যা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়ার আশংকা থাকে। গরু-ছাগলের যকৃতে, ঝিনুক, মাছ, ডিম, সয়া খাদ্য, সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও মাছ ইত্যাদি কোবাল্টের ভালো উৎস। ডালজাতীয় উদ্ভিদ, লেটুস, বাঁধাকপি ইত্যাদিতে অল্প মাত্রায় কোবাল্ট পাওয়া যায়।

গর্ভাবস্থায় ভিটামিন কোনটা

ফ্লোরিন:- ফ্লোরিনও শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় একটি উপাদান যা বিশেষ করে হাড় ও দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফ্লোরিনের অভাবে দাঁত ও হাড়ের ক্ষয় বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। ফ্লোরিনের প্রধান উৎস্য পানিই তবে সামুদ্রিক মাছ, চা এবং কফিতেও এটি বিদ্যমান। প্রতিদিনের জন্য নিরাপদ মাত্রা ১.৫ থেকে ৫.০ মিলিগ্রাম।

ম্যাংগানিজ:- সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন এনজাইম তৈরিতে এবং এনজাইম সংক্রান্ত বিভিন্ন বিক্রিয়া ঘটাতে ম্যাংগানিজ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। দীর্ঘদিন ধরে উপাদানটির স্বল্পতা হাড়কে দুর্বল ও ভঙ্গুর করে তোলে। পূর্ণ শস্যদানা, বাদাম, চা-কফি, পাতাবিশিষ্ট সবুজ শাক-সবজিতে ম্যাংগানিজ পাওয়া যায়। শর্করা, ফ্যাটি এসিড এবং আমিষের বিপাকে, রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে, রক্ত জমাট বাঁধার কাজে, হাড় তৈরি, শক্ত ও মজবুত করতে, মস্তিষ্ক, স্নায়ুতন্ত্র ও রোগ-প্রতিরোধক তন্ত্রের সঠিক পরিচালনা, মাইটোকনড্রিয়াতে বিদ্যমান সুপার অক্সাইড নামক ফ্রি রেডিকেলকে বিশ্লেষিত করে ক্ষতিকর প্রভাবমুক্ত করা ইত্যাদি কাজে এই ম্যাংগানিজ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

ক্রোমিয়াম:- শরীরের শর্করা, চর্বি এবং আমিষ জাতীয় পদার্থগুলোর বিপাকীয় কার্যক্রম পরিচালনায় ক্রোমিয়াম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তাই  ক্রোমিয়াম সামান্য স্বল্পতা থেকেও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। ক্রোমিয়াম রক্তে এইচডিএল-এর পরিমাণ বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে। ক্রোমিয়ামের অভাবে রক্তবাহী ধমনি সরু হয়ে ওঠা, উৎকণ্ঠা বৃদ্ধি পাওয়া, শরীরের শক্তি কমে যাওয়া, মানসিক অস্থিরতা দেখা দেয়া, শিশুদের শরীরের বৃদ্ধি হ্রাস পাওয়া, সার্জারি থেকে সৃষ্ট ক্ষত বা যে কোনো ধরনের ক্ষত থেকে আরোগ্য লাভ বিলম্বিত হওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। ডার্ক চকলেট, মাশরুম, পনির, বাদাম, পূর্ণ শস্যদানা, লেটুস, পেঁয়াজ, পাকা টমেটো, গোল মরিচ এবং বিভিন্ন মশলা, ডালজাতীয় শস্য ইত্যাদি থেকে ক্রোমিয়ামে ভালো উৎস।

One thought on “শরীরের জন্য অপরিহার্য খনিজ উপাদান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *