আন্তর্জাতিক

নবীযুগের প্রাচীন বাজার চিহ্নিত সৌদি আরবে…

সুক হুবাশা ছিল ইসলাম-পূর্ব যুগে আরব উপদ্বীপের প্রসিদ্ধ বাজারগুলোর একটি । ছিল তিহামাহ অঞ্চলের সবচেয়ে পুরনো বাজার এটি। পবিত্র মক্কা নগরী থেকে আট দিনের দূরত্বে তা অবস্থিত। এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হিজাজ ও ইয়েমেনের ব্যবসায়ীরা আসতেন। ইয়েমেন থেকে শাম অঞ্চলে যাওয়ার প্রাচীন বাণিজ্যপথ ছিল এটি। প্রতিবছর রজব মাসের শুরু থেকে আট দিন পর্যন্ত এই বাজার চলত। ক্রেতা ও বিক্রেতাদের মাতিয়ে রাখতে এখানে কবি ও সাহিত্যকদেরও আগমন ঘটত। কবিতার মাধ্যমে গোত্রীয় গৌরব, শৌর্য-বীর্য, বীরত্ব তুলে ধরত তারা।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৭ হিজরিতে দাউদ বিন ঈসার যুগে এর পতন ঘটে। ইসলাম-পূর্ব সময়ে মহানবী মুহাম্মদ (সা.) এখানে বাণিজ্য করেছেন। তিনি এখানে খাদিজা (রা.)-এর বাণিজ্য করতেন। ইসলামী যুগ, উমাইয়া যুগ ও আব্বাসি যুগের কিছুকাল পর্যন্ত এই বাজারের কার্যক্রম চলে। তখন সৈন্যসহ একজন প্রতিনিধি পাঠানোর রীতি ছিল। তারা সেখানে তিন দিন অবস্থান করতেন। সেই বছর আজদ গোত্রের কেউ প্রতিনিধিদলকে হত্যা করে। তখন মক্কার গভর্নরের নির্দেশনায় পুরো স্থান নিশ্চিহ্ন করা হয়। এর পর থেকে সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্যও বন্ধ হয়ে যায়। এখানে পাথরখচিত স্মৃতিস্তম্ভসহ বিভিন্ন প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া যায়।

প্রাচীন ইয়েমেনের মিখলাফ আল-জুনদ এলাকার পাতলা লিনেন, বারিক উপত্যকার শস্য-ফসল, মধু, ঘিসহ নানা রকম সুস্বাদু খাবার পাওয়া যেত। তা ছাড়া মূল্যবান পাথর, স্বর্ণ, রৌপ্য, সিসা, ইসমিদ সুরমা, সুগন্ধি, অস্ত্রের সরঞ্জাম, রেশম, জোয়াল, জুতা, ধাতুসহ খাবারের মূল্যবান পাত্র ও সামগ্রীর জন্য তা বিখ্যাত ছিল। এখানে বিভিন্ন অঞ্চলের পণ্যসামগ্রীর প্রদর্শনী হতো। যুদ্ধবন্দি ও দাসদের বেচা কেনাও হতো এখানে। প্রসিদ্ধ সাহাবি জায়েদ বিন হারেসা (রা.)-কে দাস হিসেবে এই বাজারে বিক্রয় করা হয়েছিল।

হিজরি তৃতীয় শতকের ঐতিহাসিক মুহাম্মদ বিন সাআদ লিখেছেন, হুবাশা বাজার সবচেয়ে বড় ছিল, প্রতিবছর রজব মাসে আট দিন এই বাজার অনুষ্ঠিত হতো। ইসলাম-পূর্ব যুগে হাকিম বিন হিজাম (রা.) প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী ছিলেন। মক্কা ও তিহামাহ অঞ্চলের এমন কোনো বাজার ছিল না যেখানে তিনি উপস্থিত হতেন না। তিনি বলেছেন, তিহামাহ অঞ্চলে অনেক বাজার ছিল। এর মধ্যে মক্কা থেকে এর দূরত্ব আট দিনের। আমি সেখানে সব সময় যেতাম। আমি রাসুল (সা.)-কে সেখানে উপস্থিত হতে দেখেছি। আমি কাপড় ক্রয় করে তাঁকে নিয়ে মক্কায় ফিরে আসি। এরপরই খাদিজা (রা.) তাঁকে হুবাশায় ব্যবসার জন্য পাঠিয়েছিলেন। মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে তার দাস মাইসারাও ছিল। তারা উভয়ে বিভিন্ন পণ্যের ক্রয়-বিক্রয় করে মক্কায় ফেরেন। এই ব্যবসায় তাঁরা ভালো লাভ করেছিল। (আত-তাবাকাত আল-কুবরা, ১/২১৬)

ঐতিহাসিক হুবাশা বাজারের সঠিক অবস্থান নিয়ে নানা মত রয়েছে মক্কা অঞ্চলের আরদিয়াত শহরের ‘কানুনা’ উপত্যকার পশ্চিম-দক্ষিণে হুবাশা বাজারের অবস্থান বলে জানান। ২০২১ সাল থেকে এর অবস্থান চিহ্নিত করতে কাজ করেছে সৌদি আরবের প্রত্নতত্ত্ববিষয়ক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান কিং আবদুল আজিজ ফাউন্ডেশন ফর রিসার্চ অ্যান্ড আর্কাইভস। সম্প্রতি সৌদির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিষয়ক কমিশনের সহযোগিতায় একদল গবেষক বাজারটির সম্ভাব্য অবস্থান চিহ্নিত করে। হুবাশা বাজারবিষয়ক সায়েন্টিফিক কমিটির প্রধান ফাহাদ আল-সামারি জানিয়েছেন, ‘হুবাশা বাজার চিহ্নিত করতে একটি কমিটি গঠিত হয়। এতে গবেষক, ইতিহাসবিদ, ভূগোলবিদ, সিরাত বিশেষজ্ঞ ও প্রত্নতত্ত্ববিদ রয়েছেন। ঐতিহাসিক উকাজ বাজারের নথিপত্র, মহানবী (সা.)-এর স্মৃতিবিজড়িত একাধিক স্থান ও ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে এই অনুসন্ধান চালানো হয়।’ ঐতিহাসিক এই বাজার সৌদি আরবের প্রত্নতাত্ত্বিক বিকাশ এবং ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক স্থাপনার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সূত্র : আলজাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *