লবঙ্গ কার্যকরী একাধিক অসুখে
লবঙ্গ কার্যকরী একাধিক অসুখে
লং বলেও ডাকা হয় লবঙ্গকে। আর্য়ুবেদিক চিকিৎসায় যুগ যুগ ধরে লং বা লবঙ্গের ব্যবহার হয়ে আসছে। লং বা লবঙ্গকে বলা যেতে পারে রান্নার প্রাণ দৈনন্দিন জীবনে লবঙ্গ রান্নার অনেক খানি জুড়ে আছে। লবঙ্গ রান্নাকে সুগন্ধিতে ভরিয়ে দেয় আর সুস্বাদু করে তোলে। জনপ্রিয় মশলা লবঙ্গ হচ্ছে লবঙ্গ গাছের শুকিয়ে যাওয়া ফুল। আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরিতে লবঙ্গ গাছের নানা অংশ যেমন শুকনো ফুল, ডাল এবং পাতা ব্যবহার হয়ে আসছে।
চির সবুজ লবঙ্গ গাছের ইংরেজি নাম ক্লোভ এবং বৈজ্ঞানিক নাম সিজিজিওমোরোমেটাম। লবঙ্গের ইন্দোনেশিয়ায় আদিবাস হলেও ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলংকায় প্রচুর পরিমাণে লবঙ্গ উৎপাদিত হয়। মাদাগাস্কার এবং ইন্দোনেশিয়ায় ব্যাপক ভাবে লবঙ্গ চাষ করা হয়। লবঙ্গ গাছের ফুলের কুড়িকে শুকিয়ে তৈরি করা হয়।
ইউজেনল’ নামের যৌগ লবঙ্গের সুগন্ধের মূল কারণ। ইউজেনল লবঙ্গ থেকে প্রাপ্ত তেলের মূল উপাদান, এবং এই তেলের প্রায় ৭২-৯০% অংশ জুড়ে ইউজেনল বিদ্যমান। ইউজেনল নামের যৌগটির জীবাণুনাশক এবং বেদনা নাশক গুণ রয়েছে। ১০০ গ্রাম লবঙ্গে ৬৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৬ গ্রাম প্রোটিন, ১৩ গ্রাম টোটাললিপিড, ২ গ্রাম সুগার, ২৭৪ কিলো-ক্যালোরি শক্তি ও ৩৩ গ্রাম ডায়েটারিফাইবার থাকে। লবঙ্গের তেলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো অ্যাসিটাইল ইউজেনল, বেটা-ক্যারোফাইলিন, ভ্যানিলিন, মিথাইল স্যালিসাইলেট, ফ্ল্যাভানয়েড, ইউজেনিন, ক্র্যাটেগলিকঅ্যাসিড, ট্যানিন, গ্যালোট্যানিক অ্যাসিড, র্যাম্নেটিন, ইউজেনটিন, ট্রি-টেরপেনয়েড, ক্লিনোলিক অ্যাসিড, স্টিগ্মাস্টেরল, সেস্কুইটার্পিন।
লবঙ্গে খনিজের মধ্যে আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, জিঙ্ক কমবেশি সবই আছে। আর ভিটামিনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- সি, এ, ই, ডি, কে, বি-৬, বি-১২, থায়ামিন, রাইবোফ্লাভিন, নিয়াসিন, ফোলেট রয়েছে। এই সব যৌগের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য আছে।
একাধিক অসুখে লবঙ্গ আশ্চর্যজনকভাবে কার্যকরী। শরীরে তৈরি হওয়া ফ্রি র্যাডিকেলস ধ্বংস করতে পারে লবঙ্গের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। ফলে হার্টের অসুখ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সারও প্রতিরোধেও বিশেষ ভূমিকা নেয় লবঙ্গ। প্রতিদিন খালি পেটে লবঙ্গ চিবালে একাধিক অসুখের আশঙ্কা কমে যায়। বিশেষ করে পরিপাকতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে চাইলে ও দাঁতের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে চাইলে লবঙ্গের জবাব নেই। জেনে নিন লবঙ্গের স্বাস্থ্য উপকারিতা-
# ক্যানসার প্রতিরোধ করে লবঙ্গ। বিশেষ করে ব্রেস্ট ক্যানসার, ওভারিয়ান ক্যানসার প্রতিরোধ করে থাকে।
# পরীক্ষায় দেখা গেছে লবঙ্গের উপাদান হাড়ের জোর ও বোন ডেনসিটি বাড়াতে সাহায্য করে। লো-বোন মাস এমন একটি অবস্থা, যা বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যে অস্টিয়োপোরোসিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
# লবঙ্গতে উপস্থিত অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান শরীরে প্রবেশ করার পর এমন কিছু বিক্রিয়া করে যে নিমেষে দাঁতের যন্ত্রণা কমে যায়। লবঙ্গ দাঁতের ব্যথা দূর করে ও মাড়ির ক্ষয় নিরাময় করে। প্রায় সব টুথপেস্টের কমন উপকরণ এই লবঙ্গ।
পুরুষদের শরীরে টেস্টোস্টেরনের ক্ষরণ বাড়াতে
# লবঙ্গ হজম প্রক্রিয়া উন্নত করতে সাহায্য করে। যেমন- গ্যাস, বমিভাব এবং বদহজমের মতো অনেক সমস্যায় লবঙ্গ খুব উপকারী। এছাড়াও লবঙ্গ প্রতিদিন খেলে গলায় সংক্রমণ হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। বুকের জমে থাকা কফ বের হয়ে যায়। হজম, পিত্তবিনাশকারী, হাঁপানি, জ্বর, বদহজম, কলেরা, মাথাব্যথা, হাঁচি এবং কাশির মতো রোগেও এটি বিশেষ উপকারী। লিভারে নতুন ও স্বাস্থ্যকর কোষ তৈরিতে সাহায্য করে লবঙ্গ। লিভার থেকে বিভিন্ন ক্ষতিকর পদার্থ বের করে দিতেও কার্যকরী ভূমিকা নেয়। আসলে লবঙ্গে রয়েছে থায়মল এবং ইউজেনল নামে সক্রিয় উপাদান যা লিভারকে করে তোলে শক্তিশালী। তাই প্রত্যেক দিন রাতের বেলা ঘুমানোর আগে ১ টি লবঙ্গ ও ১ গ্লাস গরম পানি পান করলে বিভিন্ন ধরনের রোগ থেকে মুক্তি মেলে সহজেই।
# কামোদ্দীপক ও যৌন রোগে উপকারি লবঙ্গ । লবঙ্গ কামোদ্দীপক। এর সুবাস অবসাদ দূর করে, শরীর ও মনের ক্লান্তি ঝরিয়ে দেয়। যৌন শক্তি বৃদ্ধি করে।
# লবঙ্গের আর একটি উপাদান হল নাইজেরিসিন। বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, এই উপাদানের জন্যই রক্ত থেকে শর্করা বিভিন্ন কোষে পৌঁছে দেওয়া, ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলোর কার্যক্ষমতা বাড়ানো ও ইনসুলিন নিঃসৃত হওয়ার পরিমাণ বাড়ানোর মতো কাজ ভালো ভাবে হয়। তাই মধ্য মাত্রার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে লবঙ্গ ভালো কাজে দেয়।
# লবঙ্গের সুগণ্ধ বমিবমি ভাবদূর করে। ট্রেনে বা বাসে যাওয়ার সময় যদি মাথা ঘুরতে থাকে ও বমি এসে যায়, তাহলে মুখে একটি লবঙ্গ রেখে সেই রস চুষলে বমি ভাব ও মাথা ঘোরা কমে যাবে। গর্ভবতী মায়েরা সকালের বমিবমি ভাব দূর করতে লবঙ্গ চুষতে পারেন।
# সর্দি–কাশি ও ঠাণ্ডা লাগা কমায় লবঙ্গ। লবঙ্গ সর্দিকাশির মহৌষধ হিসেবে বহু বছর ধরেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। লবঙ্গ চিবিয়ে রস গিলে খেলে বা লবঙ্গ মুখে রেখে চুষলে সর্দি, কফ, ঠাণ্ডা লাগা, অ্যাজমা, গলাফুলে ওঠা, রক্ত পিত্ত আর শ্বাস কষ্টে সুফল পাওয়া যায়। ধোঁয়া, রোদ এবং ঠান্ডার জন্য শ্লেষ্মা বেড়ে নানা ধরনের মাথা ব্যথা বা মাথার রোগ দেখা দিতে পারে। মাথা ব্যথা কমাতে লবঙ্গের উপকারিতা অপরিসীম।
# লবঙ্গ প্রচণ্ড স্ট্রেস ও উৎকণ্ঠা কমায়। এক টুকরো লবঙ্গ মুখে ফেলে চুষে চুষে খেয়ে ফেলুন। পান করতে পারেন লবঙ্গের চাও। মেজাজ ফুরফুরে হয়ে উঠবে।
# লবঙ্গ রক্ত পরিশোধন করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। লবঙ্গ শরীর থেকে ক্ষতিকর উপাদানগুলো সরিয়ে রক্তকে পরিশোধন করতে ভূমিকা রাখে। শরীরের রক্ত প্রবাহেরও উন্নতি ঘটায়।
# লবঙ্গ আর্থ্রাইটিসের যন্ত্রণা কমায়। লবঙ্গে উপস্থিত অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান আর্থ্রাইটিসের প্রকোপ কমাতে সাহায্য করে। জয়েন্টপেইন কমানোর পাশাপাশি পেশির ব্যথা, হাঁটুতে, পিঠে বা হাড়ের ব্যথা এবং ফোলা ভাব কমাতেও এই ঘরোয়া ঔষধটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
সহজেই দূর হবে বগলের কালো দাগ
# লবঙ্গ ত্বকের বিভিন্ন সমস্যায় প্রাকৃতিক দাওয়াই হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে ব্রণ, ফুসকুড়ি, ত্বকের লাবণ্য চলে যাওয়া এমনকি মাথার খুসকিও দূর করে লবঙ্গ। লবঙ্গ তেল যে কোনও দাগ সহজেই তুলে দেয়। সেই সঙ্গে স্কিন টোন ভালো হয়। দাগ ছোপ মিলিয়ে যায়। এছাড়াও ত্বকের বিভিন্ন দাগ দূর করতে ব্যবহার করতে পারেন লবঙ্গ। যে কোনও দাগ ভ্যানিশ। মুখে তেল ছিটকে ফোসকা পড়েছে? মশার কামড়ে লাল হয়ে গেছে? লবঙ্গ তেলেই সমাধান।
# লবঙ্গ দারুণ কাজে দেয় ছত্রাক ব্যাকটেরিয়ার বংশ বৃদ্ধি রোধ করতে। বিশেষ করে চুল পড়া কমাতে এবং চুলের সৌন্দর্য বাড়াতে লবঙ্গ তেলের জুড়ি মেলা ভার। আধ চামচ লবঙ্গ তেলের সঙ্গে সম পরিমাণ অলিভ অয়েল মিশিয়ে সেই মিশ্রণ চুলের গোড়ায় লাগিয়ে ১০ মিনিট মাসাজ করতে হবে। ২০ মিনিট পরে ঠান্ডা পানি দিয়ে চুল ধুয়ে নিন, নিয়মিত এইভাবে চুলের যত্ন নিলেই উপকার মিলবে। লবঙ্গ তেল আর লেবুর রস একসঙ্গে মিশিয়ে লাগালেও খুশকি চলে যায়।
Pingback: হাড়ের জন্য ক্ষতিকর খাবার - Amader Khabar
Pingback: এসএমই প্ল্যাটফর্মে সর্বনিম্ন বিনিয়োগ সীমা ৩০ লাখ - Amader Khabar
Pingback: স্মৃতি শক্তি বাড়াতে জায়ফল - Amader Khabar