ভ্রমণ

কোহিনুর হীরার দুর্গ গোলকোন্ডায়

১১৪৩ সালে নির্মিত হওয়ার সময় এটি পরিচিত ছিল মনকল নামে। দুর্গের প্রবেশপথই বলে দেয়, এটি বানানো হয়েছিল শত্রুপক্ষ বা যুদ্ধ প্রতিরোধের উপযোগী করে। চূড়ায় মহাকালী ও জগদম্বা মন্দিরও দেখা মিললো। ১২ খিলানযুক্ত ত্রিতল দরবার হল পাহাড়ের একেবারে উপরে।

কোহিনুর হীরার দুর্গ গোলকোন্ডায়

ভোরে ঘুম থেকে ওঠার পর নয়াদিল্লি থেকে উড়োজাহাজে হায়দরাবাদে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে গেল। সেখানে হোটেলের আনুষ্ঠানিকতা আর মধ্যাহ্নভোজ সারতে সারতে ঘড়ির কাঁটা ছাড়িয়ে গেল আড়াইটা।

ছোটাছুটির এত ধকল সত্ত্বেও কাউকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল না। সবার অপেক্ষা গোলকোন্ডা দুর্গে যাওয়ার। মধ্যাহ্নভোজ শেষে হোটেল থেকে বাস যখন গোলকোন্ডা দুর্গের সামনে পৌঁছালো, সূর্য অনেকখানিই পশ্চিমে হেলে পড়েছে। আকাশে কড়া রোদ। পা সামনে বাড়াতেই সবার চোখেমুখে প্রায় নয় শতাব্দীর ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দুর্গ দেখার বিস্ময়। সবুজের চাদরে পাহাড়ের কোলে যে দুর্গ বলে চলেছে তার গৌরবের কথা, তার হারানো প্রতিপত্তির কথা।

তেলেঙ্গানা রাজ্যের হায়দরাবাদ শহরের পশ্চিমাঞ্চলের পাহাড়ের ওপর অবস্থিত গোলকোন্ডা দুর্গ। স্থানীয় ভাষায় এই দুর্গকে প্রথমে বলা হতো গোল্লাকুন্ড, গোল্লা অর্থ গোলাকার আর কুন্ড অর্থ পাহাড়। এর অবস্থান গোলাকার পাহাড়ে ছিল বলেই এমন নাম ছিল বলে মনে করা হয়। কালের পরিক্রমায় ঐ নাম পরিবর্তিত হয়ে গোলকোন্ডা হয়ে যায়।

আরও পড়ুন: পর্যটক এক্সপ্রেসের চলাচল শুরু

এই গোলকোন্ডা দুর্গ থেকেই মধ্যযুগে যাদব, কাকাতিয়া ও কুতুবশাহী সাম্রাজ্য পরিচালিত হতো। কাকাতিয়া আমল ১১৪৩ সালে নির্মিত হওয়ার সময় এটি পরিচিত ছিল মনকল’ নামে। পরে দুর্গটি বাহমানি সালতানাত (বাহমানি সাম্রাজ্য, যা মধ্যযুগে ভারতের অন্যতম বৃহৎ রাজ্য ছিল) দখল করে নেয়। বাহামানি সালতানাত দুর্বল হয়ে পড়লে সেই সময় সালতানাতের গভর্নর পদে থাকা সুলতান কুলি কুতুব শাহ গোলকোন্ডা স্বাধীন ঘোষণা করেন এবং এটিকে কুতুবশাহী সাম্রাজ্যের প্রধান রাজধানী করেন।

প্রবেশ ফটকে ঢুকতেই দুটি সদর দরজা। একটি দিয়ে হাতি-ঘোড়া নিয়ে প্রবেশ করতেন সুলতান বা বাদশাহ। অন্য দরজা ছিল প্রজাসাধারণের জন্য। দুর্গের প্রবেশপথই বলে দেয়, এটি বানানো হয়েছিল শত্রুপক্ষ বা যুদ্ধ প্রতিরোধের উপযোগী করে। প্রায় ৬২ বছর ধরে নির্মিত সুরম্য প্রাচীরের ভেতরে বড় গ্রানাইট পাথর কোথাও ছোট পাথর, আবার কোথাও উভয়ের মিশেল চোখে পড়ে।

গোলকোন্ডা দুর্গ সদর দরজা দিয়ে ভেতরে যেতেই অবাক কাণ্ড। দুর্গের গাইড দুই হাত জড়ো করে জোরে তালি বাজালেন যা দুর্গের উপরের কক্ষ থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে। গাইড জানান, দুর্গের সামনে কোনো শত্রুপক্ষ এলে এমন কৌশলেই উপর মহলের সিপাহীদের সতর্কতা সংকেত দেওয়া হতো, যা পৌঁছে যেতো সুলতান বা অন্দরমহল পর্যন্ত।

গাইড দুর্গের উপরের দিকে উঠতে উঠতেই ভবনসহ স্থাপনাগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। অস্ত্রাগার, নাগিনা বাগ, আক্বনা মাদন্না (দুই মন্ত্রীর দ্বিতল কার্যালয়), রামদাস জেল, কুতুবশাহী মসজিদ ইত্যাদি দেখতে দেখতে পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিল সবাই। চূড়ায় মহাকালী ও জগদম্বা মন্দিরও দেখা মিললো। ১২ খিলানযুক্ত ত্রিতল দরবার হল পাহাড়ের একেবারে উপরে। এখান থেকে পাখির চোখে’ পুরো হায়দরাবাদ শহর দেখা যায়। একেবারে উপর দেখা যায় প্রায় ৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে পতিত দুর্গের আনাচে-কানাচ।

প্রায় ৪৮০ ফুট উঁচুতে উঠে সবাই হাঁপাচ্ছিল যখন, অনেকেই তখন গাইডকে প্রশ্ন করে, সে সময় দুর্গের এত উপরে পানি মিলত কোথায়? আমাদের গাইড জানান, ২০-২৫ জন লোক ৪৮০ ফুট দূর থেকে চরকা ঘুরিয়ে পানি তুলে আনতেন রাজপরিবারের জন্য। এর মধ্যে আবার পাথুরে দেয়ালে একটি গোলাকার ভরাট জায়গা দেখিয়ে গাইড বলেন, দুর্গ থেকে বাইরে যাওয়ার জন্য গুপ্ত রাস্তা ছিল অবশ্য এটি পরে বন্ধ করে দেয় সরকার।

একনো প্রচলিত আছে, কোহিনুর, জ্যাকব, হোপসহ বহুমূল্যবান হীরা ছিল গোলকোন্ডা দুর্গে। এর মধ্যে দুর্গের অদূরে বিজয়বরা কুত্তুর গ্রামের এক নারী পেয়েছিলেন কোহিনুর হীরা। ঐ বয়স্ক নারী সেটি পরে উপহার হিসেবে গোলকোন্ডার অধিপতিকে দিয়েছিলেন। তখন কোহিনুর হীরা রাখা হয় দুর্গের নাগিনাবাগে। অবশ্য বহিঃশত্রুর আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হয় গোলকোন্ডা। লুট হয়ে যায় কোহিনুর হীরা এক সময় দিল্লির সুলতান, মুঘল সম্রাট আর পাঞ্জাবের শাসকদের হাত ঘুরে চলে যায় ব্রিটিশ রাজপরিবারে।

আরও পড়ুন: ভিসামুক্ত পর্যটন সেবা চালু করলো তুরস্ক

গোলকোন্ডার কুতুবশাহী; সাম্রাজ্যের পতন সম্পর্কে জানা যায়, মুগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের বাহিনী এই দুর্গ ছেড়ে দিতে সে সময়কার সুলতান অর্থাৎ কুতুবশাহী সাম্রাজ্যের অষ্টম ও শেষ শাসক আবুল হাসান কুতুব শাহকে বার্তা পাঠায়। কিন্তু সুলতান তাতে সাড়া দেননি যুদ্ধাবস্থা চলছিল, এমন এক সকালে নাস্তা সারছিলেন আবুল হাসান। আওরঙ্গজেবের বাহিনীর কাছে তখন গ্রেপ্তার হন তিনি। ঐ সময় সুলতানকে জিজ্ঞেস করা হয়, এই অবস্থায়ও আপনি নাস্তা করছেন জাহাঁপনা জবাবে সুলতান আবুল হাসান উত্তর বলে ছিলেন, কখন কী ঘটবে তা স্রষ্টা নির্ধারণ করে দেন। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।

সন্ধ্যায় গোলকোন্ডা দুর্গে প্রায় ১ ঘণ্টার সাউন্ড অ্যান্ড লাইট শো। এই দুর্গের উত্থান-পতনের ইতিহাস নিয়ে ভারত সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের ১৯৯২ সালে নির্মিত এই শো। কিংবদন্তি অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের ভারী গলায় একের পর ধারা বর্ণনা মোহে ডুবিয়ে রাখে সবাইকে। ফাঁকে ফাঁকে শোনা যায় কবিতা কৃষ্ণমূর্তিসহ আরও কিছু শিল্পীর গলা। শোর শেষাংশে বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী জগজিৎ সিংয়ের দরাজ কণ্ঠের একটি গান বাজানো হয়। এক গুলশান থা জলওয়ানুমা…’ শিরোনামের এই গান যেন একরাশ বিষাদ নামায় হৃদয়পটে।

One thought on “কোহিনুর হীরার দুর্গ গোলকোন্ডায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *